।। তাইফুর সরোয়ার।।
বন্যেরা বনে সুন্দর,
শিশুরা মাতৃক্লোড়ে।
-এটাই প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম। এই নিয়মের কোন ব্যত্যয় হলে সেখানেই নেমে আসে বিপর্যয়। আমরা, মানুষরা, প্রকৃতিকে ধ্বংস করেছি ক্রমাগত। নিজেদের মনের আনন্দের জন্য আমরা প্রকৃতির স্বাভাবিক ধারায় বাঁধা সৃষ্টি করেছি, বন্যপ্রাণীর অবাসস্থান ধ্বংস করে জয়োল্লাস করেছি।
করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে গত মার্চ মাস থেকে দেশের সব প্রাকৃতিক দর্শনীয় স্থান বন্ধ থাকায় এসব স্থানে মানুষের আনাগোনা ছিলনা বললেই চলে। আঘাতের পর আঘাতে জর্জরিত প্রকৃতি এই অবসরে নিজের ক্ষত অনেকটা শুকিয়ে নিয়েছে। মানুষের বিঘ্ন না থাকায় প্রকৃতি নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছে নিজস্ব ধারায়। করোনার দিনগুলোতে সংক্রমণের ভয়ে মানুষ গৃহবন্দি থাকার, প্রাণ খুলে হেসেছে প্রকৃতি। প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম মেনে নির্ভয়ে বিচরণ করেছে ডলফিন, বানর, হনুমান, হরিণের মত লাজুক বন্যপ্রাণীরা।
পৃথিবীর সুন্দর সব জায়গায় পর্যটকের সমাগম নেই, নেই তাদের ফেলে যাওয়া ময়লার স্তূপ ও দূষণ। পরিচ্ছন্ন পরিবেশ ও নির্মল বায়ুর সুবাদে জাপান ও থাইল্যান্ডে বানর ও হরিণ দিব্বি ঘুরে বেড়িয়েছে। একই ভাবে পৃথিবীর ব্যস্ত শহরগুলিতে ফাঁকা রাস্তা-ঘাটে দেখা মিলেছে অনেক নাম না জানা পরিযায়ী পাখির। জনশূন্য ও দূষণমুক্ত কক্সবাজারেও ভেসে উঠেছে দুর্লভ গোলাপী ডলফিন। সংক্রমণের ভয়ে কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকতে পর্যটকদের যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারির পাঁচ দিনের মাথায় প্রকৃতি তার নিজ রূপ ফিরে পায়। দেখা মিলে ১০-১২টি ডলফিনের। গভীর সাগর থেকে দল বেঁধে ডলফিন চলে এসেছে সৈকতের কাছাকাছি। ডলফিনের ডুব–সাঁতারে মুগ্ধ হয়েছে প্রত্যক্ষদর্শীরা। ডিম পাড়তে এসেছে মা কচ্ছপ। বিশাল বালুচরে লাল কাঁকড়ার বিস্তার ঘটেছে অনেক। রাঙ্গামাটি, বান্দরবন, সেন্ট মার্টিন, কুয়াকাটা, সুন্দরবনের মতো পার্বত্য ও উপকূলীয় এলাকাও মুখরিত হয়েছে বিভিন্ন দূর্লভ প্রজাতির পাখির কুহুতানে। লোকজনের কোলাহল না থাকায় দেশের বিভিন্ন চিড়িয়াখানায় বিভিন্ন প্রজাতির পাখি, সাপ, হরিণ, কুমিরের বংশ বৃদ্ধি হয়েছে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে অনেক বেশি।
দেশে সংক্রমণের মাত্রা কিছুটা কমে আসায় সরকার পর্যাক্রমে প্রায় সব কিছুই খুলে দিচ্ছে। গত সোমবার থেকে পর্যটকদের জন্য খুলে দেয়া হয়েছে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত। অন্যান্য প্রাকৃতিক দর্শনীয় স্থানগুলোর কিছু ইতোমধ্যে খুলে দেয়া হয়েছে, কিছু অচিরেই খোলার পথে।
করোনার বন্ধে সুস্থ হওয়া প্রকৃতি সংরক্ষণে এগিয়ে আসতে হবে সকলকে। নিজেদের মুহূর্তের আনন্দের জন্য প্রকৃতিকে নতুন করে আর ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়া যাবে না। প্রকৃতি ও জীব বৈচিত্র্যের স্বাভাবিক ধারা রক্ষায় সবাইকে এক সাথে কাজ করতে হবে। এজন্য কঠোর আইন প্রনয়ন ও বাস্তবায়ন আবশ্যক। ঝুঁকিপূর্ণ প্রাকৃতিক স্থান দর্শনে প্রবেশাধীকার সংরক্ষণ করা উচিৎ। প্রকৃতিকে বিরক্ত না করে আমরা যেন সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারি- সে বিষয়ে আমাদের সকলকে আন্তরিক হতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে – প্রকৃতি ও জীবন, মূদ্রার এপিঠ ওপিঠ। প্রকৃতি বাঁচলে আমরা বাঁচব।