শিশুদের প্রতি আমাদের আচরণ ও কিছু কথা

মোঃ আশরাফুল আলম
প্রতিটি পরিবারের জন্য একজন শিশু সৃষ্টিকর্তার শ্রেষ্ঠ আশির্বাদ।আজকের শিশুই একসময়ে পিতা। শিশুদের আচরণ মূলত তার আশপাশের মানুষদের বিভিন্ন আচরণের প্রতিফলন। তাই অনেক সময় শিশুরা পারিপার্শ্বিকতা দেখে দেখে জেদী, অবাধ্য, একরোখা, মারামারি আর ঝগড়া প্রবণ হয়ে উঠে।
আর তার সাথে সাথে অভিভাবকেরাও পাল্টা খারাপ আচরণ করতে থাকে যাতে সে এসব থেকে মুক্ত হতে পারে। তারা শিশুর উপর বিভিন্ন উপায়ে মানসিক আর শারীরিক অত্যাচার করতে থাকেন। মানসিক অত্যাচারের মধ্যে ধমক দেওয়া, শিশুর করা অহেতুক প্রশ্নের উত্তরে ঝাঁজিয়ে ওঠা, অন্যদের সামনে তাকে বিদ্রুপ করা, ঘর থেকে বের হয়ে অন্য ঘরে চলে যেতে বলা, তার সাথে তাচ্ছিল্যের সুরে কথা বলা, অন্য শিশুর সাথে তুলনা করে তাকে ছোট করা, কথায় কথায় অকর্মণ্য বলা, কুরুচিপূর্ণ কথা বলা অধিক প্রচলিত।
আর শারীরিক অত্যাচারের মধ্যে আঘাত করা, ধাক্কা দেওয়া, মারধোর করা, চড় থাপ্পড় মারা এগুলোই বেশী প্রচলিত। অথচ শিশুর ভুল আচরণের কারণসমূহ চিহ্নিত এবং সমাধান না করেই শিশুর উপর একতরফা অত্যাচার করে শিশুর সুষ্ঠু মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত করা হয়। এ সম্পর্কে বার্নাড শ বলেছেন- To punish is to injure. শিশু এরুপ খারাপ আচরণ জন্ম থেকে লাভ করে না। সে তার মা, বাবা, আত্মীয় স্বজন, গৃহকর্মী, বন্ধু-বান্ধব, টিভি, ইউটিউব, মিডিয়া তথা পারিপার্শ্বিকতা থেকে শেখে। কারণ শিশু অনুকরণপ্রিয়।
পরিবারের সদস্যরা একে অপরের সাথে অসৌজন্য আচরণ করলে শিশুও তা শিখে ফেলে।
শিশুর বাবা তার মায়ের সাথে ধমকিয়ে কথা বলে, শারীরিক বা মানসিক অত্যাচার করে, তাদের মধ্যকার দাম্পত্য কলহ দেখে শিশুটির ভিতরেও সহিংসতার বীজ জন্ম নেয়। সেও তার মায়ের সাথে খারাপ আর অসম্মানজনক আচরণ করতে থাকে। আবার হয়ত বাবা-মায়েরা শিশুর সামনে বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্যদের (দাদা-দাদি, নানা-নানি) নিয়ে সমালোচনা করতে থাকেন যার ফলে এসব শুনে শুনে একসময় শিশুটিও হয়ত সবার সামনে সেই বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্যটির সাথে অভদ্র আচরণ করে বসে এবং তার জন্য বাবা-মায়ের কাছে শাস্তি পায়। অথচ এই ধরনের আচরণের জন্য তার বাবা-মাই দায়ী।
আবার চাকরিজীবী বাবা-মায়েরা সারাদিন কাজের শেষে ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফেরেন। ছোট্ট শিশুটি হয়ত সারাদিন তাদের জন্য অপেক্ষায় থাকে। তাই শিশুটি তাদের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য হয়ত অহেতুক প্রশ্ন অথবা জেদ করতে থাকে। বাবা-মায়েরা ধৈর্যচ্যুত হয়ে বকা-ঝকা, ধমক আবার চড় থাপ্পড় মারাও শুরু করেন। অথচ এর জন্য শিশুটির প্রতি তাদের উদাসীনতা আর মন:সংযোগ না করাই দায়ী। এতো গেল নিজের শিশু সন্তানের উপর অত্যচারের নমুনা।
কিন্তু শিশুটি যদি অন্য কারো হয়, গৃহকর্মী অথবা অধীনস্থ কর্মচারী, তাহলে অত্যাচারের মাত্রা যেন আরো এক ধাপ বেড়ে যায়। একটু ভুলের জন্য কিল, ঘুষি, লাথি, সজোরে ধাক্কা, শরীরের কোন একটা অংশ পুড়িয়ে দেয়া, গভীর ক্ষত সৃষ্টি করা, গরম খুন্তি দিয়ে ছ্যাঁকা দেয়া, বাথরুমে দিনের পর দিন আটকে রাখা এবং আরো অনেক অমানবিক আর নিষ্ঠুর কায়দায় শাস্তি দিয়ে থাকে শিশুটির মালিক অথবা তার গৃহকর্ত্রী।
এছাড়াও কিছু ভয়ংকর বিকৃত মানসিকতার পুরুষের শিকারও হতে হয় অরক্ষিত কন্যা শিশুদের। যৌন হয়রানি, ধর্ষণের চেষ্টা আর ধর্ষণের মত নোংরা সহিংসতার শিকার হয় শিশুরা। সাধারণত ধর্ষণের মত জঘন্য সহিংসতার শিকার এই শিশুদের বড় অংশই নিম্নবিত্ত অথবা নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের, পথশিশু অথবা গৃহকর্মী। আবার উচ্চবিত্ত ঘরের শিশুদের অপহরণ করে মুক্তিপণের টাকা আদায়ের চেষ্টা অথবা ধরা পরার ভয়ে শিশুটিকে হত্যা ও গুম করতেও পিছপা হয় না অপহরণকারীরা।
প্রতিটা শিশুই মূল্যবান হোক সে নিজের সন্তান বা আরেকজনের, হোক সে দরিদ্র অথবা ধনী পরিবারের। ঘরে বাইরে কোনো না কোনোভাবে শিশুরা প্রতিনিয়ত নির্যাতিত হচ্ছে। অথচ এরাই ভবিষ্যতের কর্ণধার। শিশুদের প্রতি রূঢ় আর নিষ্ঠুর আচরণ পরিহার করি। শত ব্যস্ততার মাঝেও নিজ সন্তানকে সময় দেওয়ার চেষ্টা করি। আদর, ভালোবাসা ও পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে শিশুর সাথে সহযোগিতামূলক, স্থায়ী ও দৃঢ় সম্পর্ক গড়ে তুলি। পরিমিত শাসন করি, তাদের ভুলগুলো ধৈর্যসহকারে বুঝিয়ে দেই, তাদের সাথে সুন্দর মানসিক সম্পর্ক গড়ে তুলি। লেখাপড়া, খেলাধূলা, বিশ্রাম, আদরযত্ন, পরিমিত শাসন, সামাজিক ও ধর্মীয় কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের মাধ্যমে শিশুর পরিপূর্ণ বিকাশে সাহায্য করি। শুধু নিজ সন্তানদের জন্য নয়, সমাজের প্রতিটি শিশুকে নিজের সন্তান মনে করে তাদের জন্য শিশুবান্ধব সুন্দর সমাজ তৈরি করতে চেষ্টা করি। আমাদের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টাই পারে শিশুর প্রতি সব ধরনের সহিংসতা বন্ধ করতে।তবেই আমরা গড়তে পাড়বো একটা সুন্দর সপ্নের পরিবার,দেশ তথা স্বপ্নের পৃথিবী।

SHARE