জাভেদ মাহামুদ ফিরোজঃ-
ভোলার লালমোহনে ৯ ইউনিয়নের ৪০ দিনের কর্মসৃজনের প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের মোট ৫৩ টি প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে।প্রয়োজন ছাড়াই ভূয়া প্রকল্প ও নামমাত্র কাজ করে শতভাগ কাজ দেখিয়ে কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ উঠেছে বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যানদের বিরুদ্ধে।প্রকল্পের নামে প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ে মাথা পিছু প্রতি শ্রমিকের প্রতিদিন ২শ টাকা করে ৪০ দিনের কাজের জন্য বরাদ্দ হওয়া ৩ কোটি ১০ লক্ষ ৭২ হাজার টাকার কাজ শুধু উপজেলা প্রকল্প অফিসের ফাইলের কাগজ কলমে সীমাবদ্ধ রয়েছে।এতে একদিকে স্থানীয় শ্রমজীবী মানুষ তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এবং অন্যদিকে ভেস্তে যাচ্ছে সরকারের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।
উপজেলা পিআইও অফিস ও ইউনিয়ন পরিষদ সূত্রে জানা যায়,২০১৮-১৯ অর্থ বছরের গত ২৫ এপ্রিল থেকে আগামী ৩০ জনু পর্যন্ত উপজেলার ৯ ইউনিয়ন পরিষদের আওতাধীন অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান ৪০ দিনের কর্মসূচীর দ্বিতীয় পর্যায়ের রাস্তায় মাটি ভরাট কাজ চলমান রয়েছে।এই প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ হয়েছে ১ কোটি ৫৫ লক্ষ ৩৬ হাজার টাকা।৯ টি ইউনিয়নের মাস্টার রোল খাতায় কাজ বাস্তবায়নের জন্য সর্ব মোট ১ হাজার ৯৪২ শ্রমিক নারী-পুরুষের নাম উল্লেখ রয়েছে। এই প্রকল্পে প্রতি জন শ্রমিক প্রতিদিন ২শ টাকা পারিশ্রমিকে সাপ্তাহিক ছুটির দিন ব্যতিত টানা ৪০ দিন কাজ করার কথা উল্ল্যেখ থাকলেও তার বাস্তবে কোন মিল নেই।তা শুধু প্রকল্প অফিসের ফাইলের কাগজ কলমে সীমাবদ্ধ রয়েছেন।
খোজ নিয়ে জানা গেছে,উপজেলার বদরপুর ইউনিয়নের ৫টি ওয়ার্ডের ৫টি প্রকল্পের মোট শ্রমিকের সংখ্যা ধরা হয়েছে ২৭৬ জন।এই ইউনিয়নের প্রকল্প ১নং ওয়ার্ডের কাজীরচর সিকদার বাড়ির উত্তর দিকে হাসু হাওলাদার বাড়ি, ৪নং ওয়ার্ডের কাজিরাবাদ বদ্দি বাড়ির উত্তর দিকে দেওয়ান সিকদার বাড়ি, ৬নং ওয়ার্ডের রায়রাবাদ তালুকদার বাড়ির পূর্বদিকে সর্দার বাড়ি, ৭ নং ওয়ার্ডের রায়রাবাদ ধোপা বাড়ি থেকে পশ্চিম দিকে ডিসি রোড ও ৮নং ওয়ার্ডের চর কচ্ছপিয়া স্লুইজ গেট এর উত্তর দিকে তাজল ইসলাম মিয়ার বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা মেরামত।
কালমা ইউনিয়নের ৫ টি ওয়ার্ডের ৫টি প্রকল্পের মোট শ্রমিকের সংখ্যা ২২৯ জন, এর মধ্যে ১নং ওয়ার্ডের উজির মিয়ার বাড়ির কবরস্থান ভরাট এবং ২নং ওয়ার্ডের রাজ্জাক মিয়ার বাড়ি থেকে মাষ্টার বাড়ি, ৩ ওয়ার্ডের ডিসি রোডের পূর্ব দিকে কাশেমের বাড়ি, ৬ নং ওয়ার্ডের নতুন বাজার থেকে দক্ষিণ দিকে হাওলাদার বাড়ি ও ৮নং ওয়ার্ডের ভারত সরকার বাড়ি থেকে অব্দুল হাওলাদার বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা মেরামত।
পশ্চিম চর উমেদ ইউনিয়নের ৪টি ওয়ার্ডের ৪টি প্রকল্পের শ্রমিকের মোট সংখ্যা ২৭২ জন। এর মধ্যে ১নং ওয়ার্ডের কচুয়াখালী বেঁড়িবাধ থেকে ঈমানের বাড়ি, ৪নং ওয়ার্ডের পাঙ্গাসিয়া ব্যাপারী বাড়ি থেকে পশ্চিম দিকে ব্রিজ, ৫নং ওয়ার্ডের উত্তর পাঙ্গাসিয়া মাতাব্বর বাড়ি থেকে পাকার মাথা ও ৭নং ওয়ার্ডের সদর রোড থেকে পেশকার বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা মেরামত।
রমাগঞ্জ ইউনিয়নের ২ টি ওয়ার্ডের ২ টি প্রকল্পে মোট শ্রমিকের মোট সংখ্যা ১৫১ জন। এর মধ্যে ৫নং ওয়ার্ডের টেগাসিয়া থেকে জালাল মিয়ার বাড়ি পর্যন্ত ও ৮নং ওয়ার্ডের আজাহার রোড থেকে জালাল মাষ্টার বাড়ির জামে মসজিদ পর্যন্ত রাস্তা মেরামত।
লালমোহন ইউনিয়নের ১টি ওয়ার্ডের ১টি প্রকল্পের মোট শ্রমিকের সংখ্যা ১০১জন, এর মধ্যে ৬নং ওয়ার্ডের বালামচর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় হতে ৯নং ওয়ার্ডের শাহজান দেওয়ান বাড়ি পর্যন্ত রাস্তার মাটি ভরাট ও পূণনির্মাণ।
ফরাজগঞ্জ ইউনিয়নের ২টি ওয়ার্ডের ২টি প্রকল্পে মোট শ্রমিকের সংখ্যা ১৬৯ জন, এর মধ্যে ৮নং ওয়ার্ডের শাওন বাজার থেকে পশ্চিম দিকে জাফর আলীর বাড়ি ও ৯নং ওয়ার্ডের মালতিয়া বাড়ি থেকে আবুগঞ্জ জামাল চৌকিদার বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা মেরামত।
ধলীগৌরনগর ইউনিয়নের ৩টি ওয়ার্ডের ৩ প্রকল্পের শ্রমিকের মোট সংখ্যা ৩০৯ জন, এর মধ্যে ১নং ওয়ার্ডের কুলচরা উত্তর দিকে মাতাব্বর বাড়ি সড়ক, ৫ নং ওয়ার্ডের কুমারখালি আঃ রহিম ড্রাইভার বাড়ি থেকে একতা বাজার ও মাও: হাকিমের বাড়ি থেকে সুতা ব্যাপারী বাড়ির রাস্তা ও ৬নং ওয়ার্ডের চর মোল্লারজী গ্রামের আজার রোডের পূর্বদিকের ব্রীজ থেকে মান্দারতলি উত্তরদিকে আজাহার রোড ব্রিজ পর্যন্ত রাস্তা মেরামত।
চরভুতা ইউনিয়নের ২টি ওয়ার্ডে ২টি প্রকল্পের শ্রমিক মোট সংখ্যা ১৮৪ জন। এর মধ্যে মোতাহার উদ্দিনের বাড়ি থেকে পূর্ব দিকে বেড়িঁবাধ পর্যন্ত ও ৮নং ওয়ার্ডের মিঝি বাড়ি থেকে চাম্পার মোড় পর্যন্ত রাস্তা মেরামত।
লর্ডহার্ডিঞ্জ ইউনিয়নের ৪ টি ওয়ার্ডের ৪ টি প্রকল্পে মোট শ্রমিকের সংখ্যা ২৫১ জন। এর মধ্যে ২নং ওয়ার্ডের জিএম বাজার থেকে দক্ষিণ দিকে মাদ্রাসা সংলগ্ম রাস্তা, ৯নং ওয়ার্ডের উত্তর লর্ডহার্ডিঞ্জ সড়ক থেকে পাটোয়ারীর হাট রাস্তা, ৭নং ওয়ার্ডের গণির রাস্তা, ও ৩নং ওয়ার্ডেও ১টি প্রকল্প রয়েছে। তবে এর মধ্যে অধিকাংশ প্রকল্পে দৃশ্যমান তেমন কোন কাজ দেখা না যায়নি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, উপজেলার ২৮টি প্রকল্পে প্রতিদিন গড়ে ১ হাজার ৯৪২ জন শ্রমিকের টানা ৪০ দিন কাজ কারার কথা থাকলেও সেখানে মাত্র কয়েকটি প্রকল্পে মাঝে মধ্যে লোক দেখানো কিছু সংখ্যাক শ্রমিক নিয়ে রাস্তায় কিছু ঝুড়া মাটি দেয়া এবং আশপাশের বন পরিস্কার করা হয়। আবার অধিকাংশ প্রকল্পে কাজ না করেই সমাপ্ত করা হয়েছে।
আবার ইউনিয়ন পরিষদের মাস্টার রোলের খাতায় নামে বেনা শ্রমিকের তালিকা দেখানো হয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। অন্যদিকে যাদের নাম শ্রমিকের তালিকায় দেখানো হয়েছে এর মধ্যে অনেকেই এলাকার বাহিরে থাকেন এবং অনেকেই ছিনেন না বলে জানান স্থানীয়রা।
সরেজমিনে একাধিক এলাকাবাসীর সাথে আলাপকালে তারা জানান, গ্রামীণ উন্নয়নের জন্য সরকার ৪০ দিনের যে কর্মসৃজনের কাজ দেয়া হয় এলাকায় তার শত ভাগের বিশ ভাগও কাজ করা হয় না। আবার প্রয়োজন ছাড়াও রাস্তা মেরামতের প্রকল্প ধরা হয়। এই কাজের নামে বরাদ্দকৃত টাকা মেম্বার,চেয়ারম্যান ও সংশ্লিষ্ট কর্তারই নিজেদের পকেট ভারি করেন।আবার মাঝে মধ্যে কেউ প্রকল্প পরিদর্শনে আসলেও পূর্বে মেরামত করা রাস্তা নতুন করে মেরামত করা হয়েছে বলে চালিয়ে দেন মেম্বার ও চেয়ারম্যান।
তারা আরো জানান,মাঝে মধ্যে শ্রমিকদের দিয়ে লোক দেখানো কয়েক দিন কাজ করিয়ে প্রকল্পে ধরা বাকি দিনগুলো শতভাগ উপস্থিত দেখিয়ে অন্যলোক দিয়ে টাকা উত্তলন করা এবং আবার অধিকাংশ প্রকল্পের কোন কাজ না করেই উপজেলা পিআইও অফিসের কর্মকর্তা ও ইউপি চেয়ারম্যানের যোগসাজসে ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলন করে নিজেইরা উপজেলায় বসে পার্সেন্টিজ ভাগাভাগি করে নেন।যা অনেক সময় ইউপি সদস্যরাও জানেন না।এছাড়া একই অর্থ বছরের প্রথম পর্যায়ের ৪০ দিনের কর্মসৃজনের আরো ১ কোটি ৫৫ লক্ষ ৩৬ হাজার টাকার ৯টি ইউনিয়নে ২৫টি প্রকল্প রাস্তা ভরাটের বাস্তবায়নের নামে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ করেন এলাকাবাসী।
উপজেলা প্রকল্প অফিসের তালিকা অনুযায়ী ১টি প্রকল্পের কাজ সম্পর্কে এক ইউপি সদস্যর কাছে জানাতে চাইলে তিনি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমার ওয়ার্ডে যে দ্বিতীয় পর্যায়ের একটি প্রকল্পের কাজ চলছে আমি এই প্রথম আপনার কাছে শুনলাম, কবে থেকে এই কাজ শুরু হয়েছে এবং কবে নাগাদ শেষ হবে ও কারা এই কাজ করছেন আমার জানা নেই। তবে এই বিষয়ে ইউপি চেয়ারম্যান মহোদয় ও প্রকল্প অফিসারেরাই ভালো বলতে পারবেন।অধিকাংশ প্রকল্পের কাজেই একই রকম অবস্থা।
রমাগঞ্জ ও ধলীগৌরনগর ইউনিয়নের একাধিকাংশ প্রকল্পের রাস্তা মেরামত সম্পর্কে জানতে চাইলে স্থানীয় কয়েকজন ইউপি সদস্যরা জানান, আমরা কাজ সম্পন্ন করেছি। কবে কাজ শুরু করেছেন এবং কতজন শ্রমিক দিয়ে কবে কাজ শেষ করলেন এমন প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারেননি তারা।
তবে কর্মসৃজনের অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে কোন কথা বলতে রাজি হননি ইউপি চেয়ারম্যানরা। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ইউপি চেয়ারম্যান বলেন, ভাই বুঝেনইতো, ইউনিয়ন পরিষদে এখন আর কিছু নেই।এডিপি, কাবিখাসহ সকল প্রকার কাজ এখন উপর মহল থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়।আমারা পকেটের টাকা খরচ করে কি রাজনীতি করবো।কত চাঁদা মাসুল ও পিআইওসহ বিভিন্ন পার্সেন্টিজ দিয়ে কাজ করার পর আমাদের তেমন কিছু থাকেনা।
এব্যাপারে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) অপূর্ব দাস এসকল অনিয়মের বিষয়টি অস্বীকার করে তিনি বলেন,কর্মসূচীতে শ্রমিকের তালিকায় যাদের নাম আছে সে তালিকা চেয়ারম্যানই দিয়েছেন। আমি তাদের কাউকে চিনি না।নিয়মিত কাজ পরির্দশন করা হচ্ছে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি কোন সদুত্তর দিতে পারেননি।কাজে কোন অনিয়ম হলে তাদের বিল আটকে দেয়া হবে বলে আর কিছু বলতে রাজি হননি পিআইও।এ বিষয়ে জেলা ত্রাণ ও পূণর্বাসন কর্মকর্তা এবিএম আকরাম হোসেন বলেন, কাজের অনিয়মের বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখব। প্রমাণ পাওয়া গেলে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
লালমোহন উপজেলা নির্বাহী অফিসার হাবিবুল হাসান রুমি বলেন,কর্মসৃজনের কাজের বিষয়ে খোজ খবর নেয়া হচ্ছে।কাল থেকে সরেজমিনে কাজের উন্নয়ন পরিদর্শন করা হবে।যদি কোন অনিয়ম দেখা যায় তা হলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।