ঢাবিতে এক সপ্তাহে তিন ছাত্রীর আত্মহনন

অনলাইন ডেস্ক,

শিক্ষা নিয়ে যে মেয়েটির চাকরিজীবনে প্রবেশের কথা ছিল, তিনি বেছে নিলেন স্বেচ্ছামৃত্যু। আর হঠাৎ করেই সেই মেয়েটির এমন মৃত্যু মেনে নিতে পারছে না পরিবার ও সহপাঠীরা। সবাইকে প্রায় স্তব্ধবাক করে দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষার্থী মেহের নিগার দানি আত্মহত্যা করেছেন। গত শুক্রবার দুপুরে যশোরের নিজ গ্রামের বাড়ি থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এ নিয়ে গত এক সপ্তাহে আত্মহত্যা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন ছাত্রী। আর বিষয়টি উদ্বিগ্ন করে তুলেছে ঢাবি প্রশাসনকেও।

দানি কেন এই আত্মহননের পথ বেঁচে নিয়েছিলেন, সেটা এখনো জানা যায়নি। বন্ধুরা বলছেন, তিনি বেশ কিছুদিন ধরে তাদের এড়িয়ে চলতেন। প্রায় সময় একা ও মনমরা থাকতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১০-১১ সেশনের ছাত্রী দানি ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের ৫০৯ নম্বর কক্ষে থাকতেন।

মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, নানা কারণে একজন মানুষ আত্মহত্যা করতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে ব্যক্তিত্বে সমস্যা, গুরুতর মানসিক রোগ, মাদকাসক্তি, এনজাইটি, ডিপ্রেশন অথবা প্ররোচনা। এছাড়া স্বল্পশিক্ষা, দারিদ্র্য, দাম্পত্য কলহের জন্যও অনেকে আত্মহত্যা করে।

এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর ১ লাখে ৩৯ দশমিক ৬ জন আত্মহত্যা করে। বিশ্বে পুরুষের মধ্যে আত্মহত্যার হার বেশি হলেও বাংলাদেশে এই হার বেশি নারীদের মধ্যে। বিশেষ কওে, কম বয়সী মেয়েদের মধ্যে এর প্রবণতা বেশি। প্রেম-সম্পর্কিত জটিলতা, আর্থিক অনটন, দীর্ঘস্থায়ী রোগ, পারিবারিক দ্বন্দ্ব আত্মহত্যার পেছনের অন্যতম কারণ বলে চিহ্নিত করেছেন বিজ্ঞানীরা।

আত্মহত্যার সারিতে শুধু দানিই নন, সরকারি চাকরি না পাওয়া, পরিবারের অভাব-অনটন, প্রেমে ব্যর্থ হওয়া, পিতা-মাতার ভালোবাসা থেকে দূরে থাকাসহ নানা কারণে চলতি বছরেই ঢাবির ৭ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। এর মধ্যে গেল ৭ দিনেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও এর অধিভুক্ত কলেজের তিন ছাত্রী নিজেই নিয়েছেন নিজের প্রাণ।

চলতি মাসের ১২ নভেম্বর বিশ্ব ধর্ম ও সংস্কৃতি বিভাগের ছাত্রী ফাহমিদা রেজা সিলভি আত্মহত্যা করেন। প্রেমঘটিত কারণে পার্থিব জীবনে নিদারুণ হতাশা থেকে তিনি আত্মহত্যা করেন বলে ধারণা করা হয়। ঠিক পরের দিনই ১৩ নভেম্বর গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের পুষ্টিবিজ্ঞান বিভাগের লায়লা আঞ্জুমান ইভা নামের আরেক ছাত্রী ‘আত্মহত্যা’ করেন। এই তরুণী গলায় ওড়না পেঁচিয়ে রাজধানীর আজিমপুরের এক বাসায় আত্মহত্যা করেন। তার আত্মহত্যার পেছনেও প্রেমঘটিত কারণ থাকতে পারে বলে জানায় পুলিশ।

এক দিনের ব্যবধানে অর্থাৎ গত বৃহস্পতিবার রাতে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন ঢাবির আরেক শিক্ষার্থী। তবে এবার ছাত্রী নন, এক ছাত্র। যদিও বন্ধু ও হলের বড় ভাইদের তৎপরতায় শেষ পর্যন্ত বেঁচে যান ওই শিক্ষার্থী।

এর আগে চলতি বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর হাজারীবাগের একটি মসজিদ ভবনের ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেন মো. তরুণ হোসাইন (২২) নামের ঢাবির প্রথম বর্ষের এক শিক্ষার্থী। শৈশবে ‘মা’ হারানো এই ছেলেটি জীবনের সঙ্গে সংগ্রাম করেই ভর্তি হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।

৩১ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য অনুষদ ভবনের নয় তলার ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে সান্ধ্যকালীন কোর্সের এক শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেন। তার নাম তানভীর রহমান। সরকারি চাকরি না পাওয়ার ক্ষোভে তিনি আত্মহত্যা করেন বলে ধারণা করছিলেন সহপাঠীরা।

তানভীরের মৃত্যুর ঠিক পাঁচ মাস পর ১৬ আগস্ট রাতে স্বেচ্ছামৃত্যুর পথ বেছে নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী মুশফিক মাহবুব। স্বাধীনচেতা এই তরুণ আত্মহত্যার দিন সকালে দেশের শিক্ষা ও শাসনব্যবস্থার ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করে নিজের ফেসবুক আইডিতে একটি স্ট্যাটাস দেন।

১৬ অক্টোবর অভাবের তাড়নায় সুইসাইড নোট লিখে জাকির হোসেন (২২) নামের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) আরেক শিক্ষার্থী নিজ ঘরে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন। তিনি ঢাকা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র ছিলেন।

এদিকে এভাবে দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার পরও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় ক্ষুব্ধ ঢাবির নিয়মিত শিক্ষার্থীরা। তারা বলছেন, নানা কারণে হতাশ শিক্ষার্থীদের কাউন্সেলিংয়ের কথা থাকলেও বিভাগগুলো এ ব্যাপারে উদাসীন। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় জরুরি পদক্ষেপ নিতে ঢাবি প্রশাসনের প্রতি দাবি তাদের।

আত্মহত্যার বিষয়টি খুবই মর্মান্তিক ও দুঃখজনক হিসেবে মন্তব্য করে ঢাবি প্রক্টর এ কে এম গোলাম রাব্বানী ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘এভাবে শিক্ষার্থীরা আত্মহত্যা করায় আমরা খুবই উদ্বিগ্ন। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের একার পক্ষে এই মৃত্যুর মিছিল ঠেকানো সম্ভব নয়। এই সমস্যা সমাধানে হতাশাগ্রস্তদের সহপাঠী ও পরিবারের সহায়তাও দরকার।’ তিনি বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের মনে রাখা উচিত, আত্মহত্যা কোনো সমাধান নয় বরং এটি পরিবার ও সমাজ ধ্বংসের কারণ।’

এভাবে সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তারুণ্যের ঝরে যাওয়াকে ‘শিক্ষার্থীদের জানতে না পারা’ হিসেবে দেখছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মোশাহিদা সুলতানা। গতকাল নিজের ফেসবুক আইডিতে এক পোস্টে তিনি লেখেন, ‘প্রতিটি আত্মহত্যার খবর শুনে শিক্ষক হিসেবে শিক্ষার্থীদের আমরা কতটা কম জানি, সেটাই মনে হয়। বিশ্ববিদ্যালয় ও তার শিক্ষার্থীদের নিজের পরিসরের নিকটজন ভাবি। তাই তাদেরকে না জানাটা নিজের অপরাধ বলেই মনে হয়।

(আল-আমিন এম তাওহীদ, ১৮নভেম্ববর-২০১৮ইং)

SHARE