মদনপুরে নেয়ামত

ফিরোজ মাহমুদঃ

নেয়ামত উল্লাহ কবি, সাহিত্যিক, লেখক, আবৃত্তিসহ অসংখ্য গুনের অধিকারী তবে ভোলার মানুষ তাকে প্রথম আলোর নেয়ামত হিসেব চিনলেও প্রকৃত অর্থে সে অসহায় ভোলা দ্বীপের সকল মানুষের জন্য আল্লাহর নেয়ামত। আজ এ মানুষটি বের হয়েছেন বিচ্ছিন্ন ভোলার বিচ্ছিন দ্বীপ মদনপুরে ত্রাণ দিতে। তা নিয়ে তিনি তার ফেইজবুকে একটি স্টাটাস দিয়েছেন ভোলা নিউজের পাঠকদের জন্য তার লেখাটি  তুলে ধরলাম…..

“”সাইকেলে পাঁচ লিটারের কন্টিনার ঝুলিয়ে ঠুস ঠুস করতে করতে আজ মদনপুর গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে মনে হলো, বিশ্ব করোনাভাইরাস নিয়ে হুদাই টেনশন করছে। করোনাভাইরাস একটা উকুনিয় অসূখ। চুল কামিয়ে ফেললেই উকুন সরে যাবে, এমন একটা ভাব সকলের মধ্যে। যার কামড় সহ্য হয়, সে চুল রাখছে। কোনো ব্যাপারই না।
বুঝলেন না! গল্পটা খুলেই বলি।
ভোর হতেই সাইকেল নিয়ে বের হলাম রিলিপওয়ার্কে। সঙ্গে একটি কন্টিনার নিলাম, যদি দুধ পাই নিয়ে আসব। বাঁধ পেরিয়ে ইটের সলিং। তারপরে নাছিরমাঝি ঘাট। সেখানে নৌকায় ত্রানসামগ্রী উঠছে। আর ঘাটে হাঁক-ডাক দালালি সবই চলছে। হোটেল খোলা। নাস্তার অফার পেলাম কয়েকজনের কাছ থেকে, সেখানে এক মৎস্য নেতাও ছিলেন। বললাম, ‘নাস্তা করে বের হয়েছি।’
পহেলা বৈশাখ। পান্তা ইলিশ না হোক, গরমভাতে ভাজা ইলিশ খেতে কিছু ক্রেতা ঘাটে ভীর করেছে। তারা সামাজিক দুরত্ম উপেক্ষা করে নিলামে অংশ নিচ্ছে। কিন্তু ইলিশের সংখ্যা নগন্য। তাই দাম বেশি। করোনাকালে অভয়ারণ্য অভিযান মাঝ পথে বন্ধ হয়ে গেছে। তবুও কিছু আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজন নদীতে নেমে জেলেদের নিকট জরিমানার নামে চাঁদা তুলছে। তাদের কথা কেউ বলতে সাহস পাচ্ছে না। ঘাটে জেলেদের মধ্যে এই আলোচনা হচ্ছে।
দালালের বাক্সে মাছ বাড়তে বাড়তেই আমাদের নৌকা ছেড়ে দিল। ভোরের সূর্য্য নদীর জলে পড়ে ঝিলিক মারছে। মনে হচ্ছে সূর্য্য পানিতে পড়ে গলে মিশে যাচ্ছে। চোখের সীমানায় ২৫-৩০ টি জেলের নৌকা। বেশিরভাগ দাঁড় বাওয়া নৌকা দরিদ্র জেলের। জাল তুলছে, জাল ফেলছে। শিশু বৃদ্ধ সব জেলে।
আমরা যে নৌকায় উঠেছি, সেখানে সামাজিক দুরত্ব উপেক্ষা হচ্ছে। ২৫-২৬জন যাত্রী। এক শিশু বাবার কোলের মধ্যে বসে আছে। দুজনের মুখে কোনো মাস্ক নেই। সঙ্গের ব্যাগ দেখে মনে হচ্ছে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে বেড়াতে যাচ্ছেন। জানা গেল, লোকটা রতনপুর থেকে এসেছেন। যাবেন মদনপুরের চরমুন্সি। এদের মতো নৌকায় অনেকই অকারণে যাত্রী হয়েছে। আবার অনেকে পেটের দায়ে, নয়তো দায়িত্ব পালন করতে যাচ্ছেন।
মদনপুর ইউনিয়নটি মেঘনার মাঝে জেগে ওঠা চর। পূর্বে লক্ষ্মীপুর, পশ্চিমে ভোলার মূল ভূখন্ড। ভাঙনকবলিতরা ঘর বাড়ি হারিয়ে এখানে বসত করছে। দুই পাড়ের অনেক স্থায়ী বাসিন্দার এখানে বসত আছে। বিস্তীর্ণ ফসলি খেত। লগ্নিমূল্য কম। একটু পরিশ্রম করলে দুই ফসলি জমিকে তিন ফসলি জমি বানানো যায়। তার ওপর বসতি কম হওয়ায় বারবার ত্রান পাওয়া যায়। অনেকে মূল ভূখন্ডে বসত করে, কিন্তু চরের ভোটার। ত্রানের ভাগটা জনপ্রতিনিধি ঠিকমতো পৌছে দেন ভোটের আসায়। এখানের অনেকে একশ ভোট না পেয়েও ইউপি সদস্য। অনেকে বিনা ভোটে। চরের নিয়মিত আসা-যাওয়া পূবের জেলার লোকজনের।
বেলা সাড়ে ৯টার দিকে পরিষদের ঘাটে আমাদের ট্রলার থামলো। এ এলাকা ভাঙনে প্রায় বিলীন হয়ে ইউনিয়ন ভবন হুমকীর মূখে পড়ছে। ঘাটে নেমে দেখি, খেত ভরা সয়াবিন। বেশ ভালো ফল এসেছে। অনেকে মরিচ আর প্লেনডাল করেছে। অসাধারণ খেতে এই ডাল। মুরগীর গোসতে আরও স্বাদ। সয়াবিন পেকে উঠছে, কৃষকের কপালে চিন্তার রেখা। কোথায় বিক্রি করবে! প্রতি বছর সয়াবিন না পাকতে পাইকার বেপারী কৃষকের দরজায় ঘুর ঘুর করে।
ত্রান উঠছে নসিমনে। আমি সাইকেল নিয়ে একটু একটু এগুচ্ছি, আর ছবি তুলছি। এরমধ্যে মহিলা গ্রাম পুলিশের স্বামী এক মেম্বারের জন্য কন্টিন ভর্তি দুধ পাঠাচ্ছেন। এ ইউনিয়নের দু-একজন জনপ্রতিনিধি ছাড়া বাকীরা এলাকায় থাকে না। অর্থাত চরে বসত না করে তরে বসত করে। এসব জনপ্রতিনিধিদের খুশি করার জন্য চরবাসি টাটকা মাছ, তরকারি, দুধ-ডিম পাঠায়।
ইটের হেরিংবোন সড়ক। এক ইট থেকে আরেক ইটের মাঝে অনেক ফাঁকা রেখে সড়ক নির্মাণ করায় বছর না যেতে ভাঙন দেখা দিয়েছে। সাইকেলের চিকন চাকা সে ফাঁকে পড়ে যাচ্ছে।
প্লেন ডালের কমলা ফুলে মৌমাছি বসে মধু সংগ্রহ করছে। নানা রঙের প্রজাপতি। অপরূপ দৃশ্য! যারা প্রকৃত গৃহস্থ, তাঁরা বছরে সংসারে যা যা দরকার হয়, সব কিছুই খেতে ফলানোর চেষ্টা করে। যেমন কিছু অংশে ধান, কিছু অংশে ডাল ও মসলা জাতীয় ফসল। আবার পেলাউ খেতে কালিজিরা ধান, নাস্তা খেতে কাউন ধান। সবই ফলায়। মনটা কেনো জানি আনন্দে ফুল ফুর করছে। মন যেনো খুঁজে খুঁজে হারিয়ে যাওয়া ফসলের ফুল, ফল পাতার দোল খাওয়া দেখছে।
চরের সড়ক। কিন্তু কতোক্ষণ পড়ে পড়ে মোটর সাইকে আসছে। নসিমন, করিমন এখানেও। প্রতি মোটর সাইকেলে ২-৩জন যাত্রী। স্বাভাবিকভাবে যেমন চলে তেমনই। দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে সামাজিক দুরত্ম বিষয়টির যে গুরুত্ব, তা এখানে গুরুত্বহীন। দলে দলে গণজট, পাটওয়ারী বাজার, চেয়ারম্যান বাজারে চায়ের দোকানে চাপান, টিভি দেখা। বাগদা চিংড়ি রেণূ ধরার প্রস্তুতি। জাল রেডি হচ্ছে। নেমে পড়েছে অনেকে।
ত্রান প্রদানের মাঠে, আমরা শিক্ষার্থীদের সামাজিক দুরত্মে রেখে ত্রান দিচ্ছি। এটা দেখার জন্য বিশাল জমায়েত। নিষেধ করছি। কিন্তু মানছে না। তাঁরা যেনো গুরুত্বহীন।
ফিরে আসার পথে আমরা খেয়াঘাটে ট্রলারের অপেক্ষায় কলা গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নিচ্ছি। চরবাসি ঘর তুলে চারপাশে কলাগাছ লাগায়। এ কলাগাছ বর্ষায় ঝড়-বাতাসে ঢালের কাজ করে। আর গরমে শীতল। বড় বড় বিচি কলা, মাঝে মাঝে বাংলাকলা। আমরা যেখানে আশ্রয় নিয়েছি, সেটি আলমগীর মাঝির ঘর। তিনি আমাদের কল থেকে ঠান্ডা পানি এনে পান করালেন। চেয়ার দিলেন। আমি, হেলাল স্যার, সাইফুল স্যার, আল আমিন স্যার, ভোলা মানবকল্যাণ যুবসংঘের যুগ্ম-আহবায়ক আরিফ বসে কথা বলছি। এরমধ্যে সেখানে এসেছেন মদনপুর আলোর পাঠশালার প্রধান শিক্ষক আক্তার হোসেন। আমাদের জন্য পাকা কলা নিয়ে এলেন। চরের গাছপাকা বাংলাকলা। আমাদের সঙ্গে চরের কয়েক জন যোগ দিলেন। শুরু হলো, করোনাভাইরাস ও চরাঞ্চলের অবস্থা নিয়ে কথাবার্তা। সেখানে জানা গেল, এ চরের ম্যাজিস্ট্রেট হচ্ছেন ইউপি সদস্য। গ্রাম পুলিশ আছেন আইন প্রয়োগকারীর ভুমিকায়। কিন্তু অনেকেই করোনা পরিস্থিতিতে সামাজিক দূরত্ম ও জনসমাগমের বিষয়টি মানছেন না। গ্রাম পুলিশ ও ইউপি সদস্যরা মোটর সাইকেল চালায় এবং দোকানদারি করে। কেউ নিষেধ করলে ধমকে আসে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম লাগাম ছাড়া। যে যেমন পাড়ছে, তুলে নিচ্ছে। এ অবস্থায় মদনপুরে সব স্বাভাবিক গতিতে চলছে। এলাকার দায়িত্ববাণ লোক হতাশা প্রকাশ করেন।
নদীর তীরে নোঙ্গর করা জেলেরা নৌকায় পাক হচ্ছে। হলুদ পোড়ানো ইলিশ রান্নার ঘ্রান নাকে এসে ক্ষিধে জেগে উঠেছে। পথে ঘাটে খাওয়া নিষেধ। ট্রলারে মেঘনা পাড় হয়ে সাইকেলে দুধ ভরা কন্টিনার ঝুলিয়ে বাড়িতে পৌছে, ফ্রেশ হয়ে আগুনের ওপর দুধে জ্বাল বসাতে দেখা গেল, দুধ ছড়া কেটে ছানা!””

মনেউ
১৫.৪.২০

SHARE