তাইফুর সরোয়ারঃ-
নশ্বর পৃথিবীতে আমরা প্রায় ভুলতে বসেছিলাম আমাদের মনুষ্যত্ব। ভুলতে বসেছিলাম সৃষ্টি কর্তার অসীম ক্ষমতার কাছে আমাদের ক্ষমতা আসলে কতটা ঠুনকো! তাইতো নিজেদের সৃষ্টি কর্তার আসনে বসিয়ে অস্বীকার করতে চেয়েছি সৃষ্টি কর্তার সকল কৃতিত্ব, কর্তৃত্ব এবং শ্রেষ্ঠত্ব। ক্ষমতার লোভে মত্ত হয়ে ধরা কে সরা জ্ঞান করে যা ইচ্ছা তাই করেছি – নিরপরাধকে অপরাধী করেছি, নিস্পাপ কে করেছি পাপী। পথ হারা সেই মানুষগুলোর জন্য করোনা ভাইরাস একটি ধাক্কা, আত্ন উপলব্ধি করার একটি মাধ্যম, নিজেদের ভুল ত্রুটি শুধরানোর একটি উপায়।
আমরা মানুষরা অনেক নিষ্ঠুরতা দেখিয়ে চলছি, পাশবিকতার শেষ সীমাটাও আমরা অতিক্রম করেছি। অন্যায়, অবিচার, ঘুষ, দুর্নীতি, যুদ্ধ, বিগ্রহে এই সভ্যতাতো এমনিতেই এক মেকি কাঠামোর উপর দাঁড়িয়ে আছে। যারা বেশি সভ্য সেই প্রথম বিশ্ব তাদের সব শ্রম, জ্ঞান, সম্পদগুলো মারণাস্ত্র তৈরির পিছনে ব্যয় করেছে। তারাই এখন ভাবছে বিগত ভুলগুলোর কথা। ১ম ও ২য় বিশ্বযুদ্ধের বিভৎসতা ছাড়াও নিকট অতীতে সিরিয়া যুদ্ধে প্রায় ৪ লাখের বেশি, ইয়েমেন যুদ্ধে প্রায় ১ লাখ, ইরাক যুদ্ধে ১০ লাখের বেশি এবং আফগানিস্তান যুদ্ধে প্রায় ১ লাখের অধিক কিংবা মায়ানমার, চীনসহ পৃথিবীর অনেকখানে অগণিত মানুষকে হত্যা করেছে আরেক দল মানুষই তো! সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে, শান্তি প্রতিষ্ঠার নামে আমরা চালিয়েছি এই হত্যাকাণ্ড। দেখিয়েছি ধর্মীয় উন্মাদনা। এই করোনাভাইরাস প্রগতিশীল বিশ্বকে নাড়া দিয়েছে, অত্যাচারীর বিবেককে জাগিয়ে তুলেছে, তাদের বিগত ভুলগুলো ধরিয়ে দিচ্ছে। ৩য়, ২য়, ১ম বিশ্ব এখন এক কাতারে এসে দাঁড়িয়েছে। এখানে কেউ ব্রাহ্মণ, আবার কেউ নমশূদ্র নয়; কেউ ধনী, কেউ গরীব নয়; কেউ সাদা, কেউ কালো নয় – সবাই সমান। এটাই সাম্য। এটাই প্রাপ্তি, এটাই মানবজাতির জন্য সর্বোত্তম শিক্ষা।
প্রকৃতি, পরিবেশ ও প্রাণিকূল এতদিন মানবের দানবীয়তায় অসহায় হয়ে পড়েছিল, তারা অভিশাপ দিয়েছিল মানব জাতিকে। তারা আজ দেখিয়ে দিচ্ছে পৃথিবী শুধু মানুষের একার নয়, তাদেরও ভোগ করার অধিকার আছে। গৃহ বন্দি মানুষ আজ ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে তাদের দাবির ন্যায্যতাকে স্বীকার করছে।
ধর্ম সুন্দর ও পবিত্র। ধর্ম জীবনকে শুধু পার্থিব প্রাপ্তিতে সীমাবদ্ধ করে না, পারলৌকিক জীবনের জবাবদিহিতার বিষয়ে সতর্কও করে। এই ভাইরাস পৃথিবীর সবল দুর্বল প্রায় সকলকে স্রষ্টার প্রতি ধাবিত করেছে, ভুলোমনা মানুষগুলোকে সর্বশক্তিমানের অনুগ্রহের প্রতি নিবিষ্ট করেছে। অযাচিত অহংকারগুলোকে করেছে চূর্ন বিচূর্ণ। সসীম সৃষ্টিকে অসীম স্রষ্টার অনুগ্রহের দিকে মনোযোগী করার কৃতিত্ব এই ক্ষুদ্র অনুজীবকে দিতেই হবে।
এই কঠিন সময়ে অনেকখানে মনুষ্যত্বের জয়গান চলছে। আমরা মানুষরা মায়া ছড়াচ্ছি প্রতিনিয়ত। আমাদের এই দেশে চাল-গম চোরের চেয়ে অনেক বেশি মানবিক মানুষকে পাচ্ছি। শত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও জীবনকে তুচ্ছ করে চিকিৎসকরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন- দায়িত্ববোধ থেকে এইসময় সরাসরি রোগীর পাশে থাকা যেন আরেকটি মুক্তিযুদ্ধ। পুলিশ, আর্মি, প্রশাসন, সরকারের বিভিন্ন সংস্থা, স্বেচ্ছাসেবীরা মাঠে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। এসব যোদ্ধাদের অভিবাদন। ব্যতিক্রম থাকতেই পারে। তারা নগণ্য। এসব দেখে আশান্বিত হই – হয়তোবা এগুলো দেখে দুষ্ট লোকগুলোর বিবেক নতুন করে জাগ্রত হবে, নতুন এক সুন্দর মানবিক বাংলাদেশ পাব। মানুষের মনুষ্যত্ব দেখে করোনাভাইরাস হয়তো সৃষ্টিকর্তার করুণায় রূপান্তরিত হবে!
সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ হারে না, হারতে পারেনা। ইতিহাস তা-ই বলে। স্রষ্টা মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব ক্ষুণ্ণ হতে দেবেন না। এই মেঘ একসময় কেটে যাবে। মহান রাব্বুল আল আমিনের অশেষ কৃপায় এই রোগকে আমরা জয় করবো এক সময়। নতুন সূর্য উঠবে, পাখিরা গান করবে, প্রকৃতি হাসবে। আমরা ফিরে পাব ক্ষুধা মুক্ত, দারিদ্র্য মুক্ত, বৈষম্য মুক্ত সাম্য, ও ভালোবাসার নতুন পৃথিবী, ইনশাআল্লাহ।