খতির বাপের শেষ চিঠি— ১

খতির বাপের শেষ চিঠঃ

অবশেষে ডাক্তারদের প্রাপ্য সম্মান পেতে অপেক্ষা করতে হল একটি মহামারী পর্যন্ত ঐতিহাসিকভাবে ও ঐতিহ্যগতভাবে আমাদের এই উপমহাদেশে সেবক অপেক্ষা শাসক ও শোষকের প্রতিই সম্মান প্রদানের প্রবনতা বেশী, সেটা না হয় মানা গেল তাই বলে সেবককে অসম্মান ও অবমুল্যায়ন করাটা মেনে নেয়া গেলেও যথোচিত নয়। একজন মানুষ শারীরিক কিংবা মানসিকভাবে ব্যাধিগ্রস্ত হলে তাকে সারিয়ে তোলার মহান দায়িত্ব পড়ে একজন ডাক্তারের ওপরই। রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি থেকে শুরু করে একজন অতি সাধারন নাগরিক কেউই ডাক্তারের সেবার উপর অনির্ভরশীল নন। আমাদের শিক্ষা প্রক্রিয়ায় সাধারনত সর্বাপেক্ষা মেধাবী ছাত্রছাত্রীরাই সরকারী(পাবলিক) মেডিকেল কলেজ কিংবা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করে থাকে। অধ্যয়ন শেষে তারা একপর্যায়ে নিজ নিজ ক্ষেত্রে কর্মজীবনে আসে আর এরই মধ্যে একটা অংশ বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের স্বাস্থ্য ও প্রকৌশল(যেমন টেলিকম) ক্যাডারে প্রথম শ্রেনীর কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করে জনগনের সেবাদানের উদ্দেশ্যে। মজার ব্যাপার হল বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের যে কয়টি ক্যাডার আছে তার মধ্যে অন্যতম অবহেলিত ক্যাডার হল স্বাস্থ্য ক্যাডার। উদাহরন স্বরূপ মাঠ পর্যায়ে (যেমন জেলা/উপজেলা পর্যায়ে) একটি সম্মিলিত পরিবেশে একজন স্বাস্থ্য ক্যাডারের অফিসার তার সমসাময়িক অন্যান্য ক্যাডারের অফিসারদের (যেমনঃ প্রশাসন, পুলিশ, ট্যাক্স, কাস্টমস) তুলনায় অনেক ক্ষেত্রেই উপেক্ষিত থাকেন। এমনকি ইউনিয়ন বা ওয়ার্ড পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতাদেরও ডাক্তারদের উপর সুযোগ নিতে দেখা গ্যাছে জোরপূর্বক মিথ্যা ডাক্তারী সার্টিফিকেট আদায়ের জন্য। ডাক্তারদের গায়ে হাত তুলতে পিছ পা হন নি পুলিশের কনস্টেবল, এস আই এমনকি ক্যাডার অফিসাররাও; এইতো বেশীদিন হয়নি লক্ষীপুরে নিছক কথা কাটাকাটির জেড়ে জনৈক প্রশাসন ক্যাডারের অফিসার একজন ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জনকে মুহুর্তের মধ্যে মোবাইল কোর্ট করে জেলে পাঠানোর আদেশ দিয়ে নিজেদের অসীম ক্ষমতার প্রমান দেখালেন, পাবনার জেলা প্রশাসকের বাসায় তলব করার পর যেতে অস্বীকৃতি জানানোয় তাতক্ষনিক বদলি হয়ে গেলেন আরেক ডাক্তার। আর সাংবাদিকদের কথা না হয় বাদই দিলাম, তারাতো বিগত কিছু বছরে ডাক্তারদের বিরোদ্ধে একপ্রকার অঘোষিত যুদ্ধেই নেমে গেলেন, যেন বাংলাদেশের ডাক্তারদের নেতিবাচক দিক ছাড়া উল্লেখ করার মত ইতিবাচক দিকই নাই। ডাক্তারদের মধ্যে যে সামান্য একটি অংশ এই মহান পেশার সুযোগ নিয়ে কসাইরূপি কর্মকাণ্ড করে তাতে কোনো দ্বিমত নাই, কিন্তু বাংলাদেশের মত ধ্রুব বৈষম্যের দেশে সেটাই স্বাভাবিক, কারন ওই ডাক্তারগুলোওতো এই সমাজ থেকেই আসা। সাংবাদিকরা ডাক্তারদের প্রতি উপেক্ষা আর বঞ্চনা’র সংবাদ কতটা প্রকাশ করেন? সিংহভাগ ডাক্তার যে নিরলসভাবে এই দেশের জনগনকে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন সেটার উপর সাংবাদিকরা কতটুকু উতসাহমূলক সংবাদ প্রচার কিংবা পরিবেশন করেন?
কিন্তু এই উপেক্ষা দ্বারা আমরা ডাক্তারদের না যতটা অমর্যাদা কিংবা অবমূল্যায়ন করছি তার চাইতে বেশী নিজেদের ক্ষতি করছি। আজ আমাদের দেশ থেকে বিদেশে স্বেচ্ছায় পাচার হয়ে যাচ্ছে শত শত ডাক্তার, যে ছেলেটি/মেয়েটি ডাক্তারী পড়া শেষ করে চিকিতসা সেবায় নিয়োজিত হবার কথা সে আজ বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহন করে পররাষ্ট্র, পুলিশ , প্রশাসন এই সব ক্যাডারে চলে যাচ্ছে। প্রকৌশল কিংবা চিকিতসাবিজ্ঞান পড়া এইসব মেধাবী শিক্ষার্থীদের বোঝা হয়ে গ্যাছে যে বাংলাদেশের সমাজ ও রাষ্ট্র কাঠামোতে পেশাগত উতকর্ষতার চেয়ে ক্ষমতা অনেক বেশী প্রয়োজন। ক্ষমতা যেখানে টিকে থাকার নিয়ামক সেখানে ডাক্তাররাও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ব্যানারে (স্বাচিপ, ড্যাব ইত্যাদি) দলবাজি করতেই বা পিছপা হবে কেনো।
আজ কোভিড-১৯ এর এই ভয়াবহ বৈশ্বিক মহামারীতে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশও টের পাচ্ছে এই যুদ্ধে ফ্রন্টলাইন ফাইটার হচ্ছেন ডাক্তাররা ও চিকিৎসা কর্মে নিয়োজিত সংশ্লিষ্ট সবাই। ডাক্তারদের কাজ যেনো ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন কোরোনা ভাইরাসের সমন্বয়ে গঠিত একেকটি মহা দানবের পেট থেকে একেকটি আক্রান্ত মানুষকে বের করে আনার অদম্য প্রচেষ্টা, আর এটা করতে গিয়ে ইতোমধ্যে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অনেক ডাক্তারই দানবের পেটে আটকা পড়ে গ্যাছে চিরদিনের জন্য। আজ আমরা ডাক্তারদের গুরুত্ব ও তাতপর্য বুঝতে শুরু করেছি যেটা এতদিন পারিনি, ভবিষ্যতের বাংলাদেশে আমাদের এই অনুধাবনটা জারী থাকলেই হয়। রাষ্ট্রকেও বুঝতে হবে শুধুমাত্র লাঠি ঘোরানোর আর ক্ষমতা ফলানোর লোকদেরই গাড়ি বাড়ি পাইক পেয়াদা দিলেই চলবেনা বরঞ্চ এত সুবিধা না দিয়ে প্রশাসনিক ও পেশাগত বিশেষজ্ঞদের মর্যাদার সাম্য প্রতিষ্ঠিত করা তাহলে সবাই যার যার ক্ষেত্রে আত্নতুষ্টির সাথে কাজ করবে আর সামগ্রিক ভাবে এর সুফল পাবে রাষ্ট্রের নাগরিকগন।

SHARE