প্রতারণার ফাঁদে ফতুর গ্রাহক

 

নিউজ ডেস্ক ঃ ডেসটিনি ও যুবক হাতিয়েছে সাড়ে ৭ হাজার ১০০ # ইউনিপে টু ইউ ৬ হাজার, এহসান গ্রুপ ১৭ হাজার, ই-অরেঞ্জ # ১ হাজার ১০০ ও আইসিএল ৩ হাজার কোটি টাকা মামলা হয়, # মালিক গ্রেপ্তার হলেও প্রাপ্য পায় না গ্রাহক # লাভের আশায় টাকা দিয়ে লাখ লাখ মানুষ পথে বসেছে। মাল্টিলেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) কোম্পানির প্রতারণার বিষয়টি গত এক দশকের বেশি সময় ধরে বিভিন্ন সময়ে ঘুরেফিরে আলোচনায় এসেছে। ২০১২ সালে ডেসটিনি কেলেঙ্কারিতে সারাদেশে হইচই পড়লেও থেমে থাকেনি তাদের ব্যবসা। এর আগে যুবক ও ইউনিপেটুইউসহ আরও নানা নামে এমএলএম কোম্পানি খুলে সাধারণ মানুষকে লাখোপতি ও কোটিপতি হওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে এসব কোম্পানি প্রতারণার মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। প্রতারণার ঘটনায় বিভিন্ন সময়ে মামলা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ওইসব কোম্পানির কর্ণধারদের গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠায়। দায়েরকৃত মামলার বিচার চলমান। কিন্তু ওইসব কোম্পানিতে বিনিয়োগ করা লাখ লাখ মানুষ কোনো টাকা ফেরত পায়নি। অন্যদিকে গত কয়েক বছরে ই-কমার্স ব্যবসার নামেও চটকদার ছাড়ের প্রলোভন দিয়ে পণ্য বিক্রির নামে অন্তত ১৫টি কোম্পানি হাতিয়ে নিয়েছে কয়েক হাজার কোটি টাকা। এর বাইরেও বর্তমানে অন্তত অর্ধশতাধিক কোম্পানি সক্রিয় প্রতারণার কাজে। যারা গ্রাহকদের লোভের ফাঁদে ফেলে শত শত কোটি টাকার হাতিয়ে নিয়েছে। ই কমার্সের পাশাপাশি প্রতারক প্রতিষ্ঠানের তালিকায় সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে অনলাইন এমএলএম কোম্পানি। আলোচিত ই-ভ্যালিসহ আরও বেশ কয়েকটি কোম্পানির কর্ণধারদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তাদের কেউ কেউ গ্রেপ্তারের পর কারাগারে গেছে। কেউবা পালিয়েছে বিদেশে। কিন্তু প্রতারিত গ্রাহকরাএকদিকে যেমন ছাড়ের পণ্য পায়নি, তেমনি তাদের দেওয়া কোনো টাকাও ফেরত পায়নি।প্রাপ্ত তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বিভিন্ন এমএলএম, অনলাইন ও ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো নানা প্রলোভন দিয়ে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অন্তত ৪০ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এরই মধ্যে। গ্রাহকরা তাদের বিনিয়োগের এই পুঁজি ফেরত পাবেন কিনা তা অনিশ্চিত। এমন প্রেক্ষাপটে প্রতারিত লাখ লাখ মানুষ পথে বসে গেছে। কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি ও দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান আমাদের সময়কে বলেন, চটকদার অফার আর প্রলোভন দেখিয়ে কোনো প্রতিষ্ঠান যাতে গ্রাহকের অর্থ লুটতে না পারে সে জন্য সরকারের নজরদারি যেমন জরুরি, তেমনি গ্রাহকদেরও অবশ্যই সচেতন হতে হবে। গ্রাহক যখন বিনিয়োগ করছেন তখন তাকে বুঝেশুনেই করতে হবে। সরকার পারেন দোষী প্রতিষ্ঠানের সম্পদ থেকে গ্রাহকের পাওনা অর্থ ফেরত দিতে। কিন্তু আইনি প্রক্রিয়ার ফলে সেটা অনেক সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। সুতরাং গ্রাহকদের সচেতন হতে হবে আগে। এর বিকল্প নেই। অতি মুনাফার ফাঁদে ফেলে গ্রাহকদের টাকা লুটের সবচেয়ে বড় দুটি উদাহরণ ডেসটিনি ও যুবক। এ দুটি প্রতিষ্ঠান সাধারণ গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণা করে প্রায় ৭ হাজার ১০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। ৪ হাজার ১১৯ কোটি ২৪ লাখ টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগে বিচার চলছে ডেসটিনি গ্রুপের চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, পরিচালকসহ ২২ জনের। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্ত করে দেখেছে, উচ্চ হারে মুনাফার লোভ দেখিয়ে এমএলএম (বহু স্তরের বিপণন) ব্যবসা পদ্ধতিতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড এবং ডেসটিনি ট্রি প্ল্যান্টেশন লিমিটেডের বিভিন্ন প্যাকেজের শেয়ার দেখিয়ে অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন গ্রুপের পরিচালকরা। ওইসব অর্থ ৩২টি অলাভজনক প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগের নামে নিজেদের ব্যক্তিগত ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর করেছেন। অভিযুক্ত ব্যক্তিরা নিজেরা লাভবান হওয়ার জন্য ২০০৯ সালের জুলাই থেকে ২০১২ সালের জুন মাস পর্যন্ত ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটির (ডিএমসিএসএল) সাড়ে আট লাখেরও বেশি বিনিয়োগকারীর সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। এ সময় ঋণ প্রদান, অলাভজনক প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ, নতুন প্রতিষ্ঠান খোলার নামে বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে ১ হাজার ৯০১ কোটি ২৬ লাখ ২৫ হাজার টাকা সংগ্রহ করা হয়। সেই অর্থ থেকেই আসামিরা লভ্যাংশ, সম্মানী ও বেতন-ভাতার নামে ১ হাজার ৮৬১ কোটি টাকারও বেশি অর্থ সরিয়ে নেন। ২০০৬ সালের ২১ মার্চ থেকে ২০০৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আইন ও বিধি লঙ্ঘন করে গাছ বিক্রির নামে ডেসটিনি ট্রি প্ল্যান্টেশন লিমিটেডের (ডিটিপিএল) জন্য ২ হাজার ৩৩৫ কোটি ৭৪ লাখ ৮৫ হাজার ৫০০ টাকা জনগণের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়। এ অর্থ থেকে ২ হাজার ২৫৭ কোটি ৭৮ লাখ ৭৭ হাজার ২২৭ কোটি টাকা প্রতারণার মাধ্যমে আত্মসাৎ করেছেন প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষ কর্মকর্তারা। অতি মুনাফার লোভ দেখিয়ে গ্রাহকদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে যুব কর্মসংস্থান সোসাইটি বা যুবক। ১৯৯৬ সালে যুবকের নিবন্ধন দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মগুলোর নিবন্ধকের কার্যালয় (রেজসকো)।রাজধানীর শাহবাগে আজিজ কো-অপারেটিভ মার্কেটে কয়েকটি দোকান ভাড়া নিয়ে যাত্রা শুরু করে যুবক। ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠানটি উচ্চ সুদের বিনিময়ে আমানত সংগ্রহ ও ঋণদান কর্মসূচি চালু করে। ২০০৫ সালে যুবকের প্রতারণামূলক কার্যক্রম নিয়ে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে তদন্তে নামে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অবৈধ ব্যাংকিংয়ের অভিযোগে তখন যুবকের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।কিন্তু এ টাকা গ্রাহকদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব নেবে অর্থ মন্ত্রণালয়, নাকি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, তা নিয়ে কেটে যায় কয়েক বছর। এ দীর্ঘ সময়েও যুবকের তিন লাখ চার হাজার গ্রাহক তাদের পাওয়া ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকা ফেরত পাননি। এদিকে ব্যাংক হিসাব জব্দ না করায় ব্যাংক হিসাবে থাকা টাকা উঠিয়ে নিয়ে গেছেন যুবকের উদ্যোক্তারা। আবার যুবকের সম্পদ বাজেয়াপ্ত না করায় অনেক সম্পদ রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দখল হয়ে গেছে, আবার অনেক সম্পদ বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। গ্রাহকদের পাওনা, সম্পদের দায়দেনাসহ যুবকের আর্থিক কেলেঙ্কারির পরিমাণ ৪ হাজার ২০০ কোটি টাকা বলে জানা গেছে।কথিত মাল্টিলেভেল মার্কেটিং কোম্পানি (এমএলএম) ইউনিপেটুইউতে ১০ মাসে দ্বিগুণ লাভের আশায় ৬ লাখ বিনিয়োগকারীর বিনিয়োগ করা ৬ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় চেয়ারম্যান শহীদুজ্জামান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুনতাসির হোসেন। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ২০১১ সালের ইউনিপেটুইউ’র কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিনিয়োগকারীদের অর্থ আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগে মামলা করে। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিষ্ঠানটির ওপর তদন্ত করেও এসব তথ্যের প্রমাণ পায়। এ টাকা ফেরত পেতে বিনিয়োগকারীরা সরকারের সংশ্লিষ্ট অফিসের দ্বারে দ্বারে ঘুরে হয়রান। সরকারের পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ নেই। টাকা ফেরত দিতে আদালতের নির্দেশনা থাকলেও তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেই। আবার, কিছু গ্রাহক এমএলএম প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে টাকা আদায়ের মামলা করলেও তা বছরের পর বছর ঝুলছে।অতিরিক্ত মুনাফার লোভ দেখিয়ে ২০১৩ সালে প্রায় পাঁচ লাখ গ্রাহকের কাছ থেকে ৩ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় আইসিএল গ্রুপ। পরবর্তীকালে নামসর্বস্ব ১৩টি প্রতিষ্ঠান ফেলে উধাও হয়ে যায় গ্রুপটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও মূল উদ্যোক্তা শফিকুর রহমানসহ পরিচালকরা। যদিও পরে গ্রুপটির মূল উদ্যেক্তা শফিকুর রহমান ও তার স্ত্রী আইসিএল গ্রুপের পরিচালক কাজী সামসুন নাহার মিনা র‌্যাবের হাতে আটক হন। তবে এখনো প্রতারিত গ্রাহকরা টাকা ফিরে পায়নি। ১৭ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ‘এহসান গ্রুপ পিরোজপুর-বাংলাদেশ’ নামের এক কোম্পানির চেয়ারম্যান রাগীব আহসান এবং তার এক সহযোগীকে সম্প্রতি গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব। এহসান মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড, এহসান রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড বিল্ডার্স লিমিটেডসহ কয়েকটি মাদ্রাসা খুলে ওই কোম্পানি ব্যবসা চালিয়ে আসছিল। রাগীব আহসান নূরে মদিনা ক্যাডেট মাদ্রাসার অধ্যক্ষ। এক সময় তিনি মসজিদের ইমাম ছিলেন। বাড়ি পিরোজপুর সদরের খলিশাখালী এলাকায়। এক সময় তিনি এমএলএম ব্যবসা শুরু করেন এবং ২০১০ সালে এহ্সান রিয়েল এস্টেট নামে একটি কোম্পানি খোলেন। পরে আরও ডজনখানেক কোম্পানি খুলে তিনি নাম দেন ‘এহসান গ্রুপ পিরোজপুর-বাংলাদেশ। এ প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগকারী লক্ষাধিক মানুষ পথে বসতে বসেছে। তারাও কোনো টাকা ফেরত পাননি। কবে পাবেন এ গ্যারান্টিও কেউ দিতে পারছেন না। গ্রাহকের অর্থ আত্মসাতের পর প্রতিষ্ঠানের মালিকদের কেউ কেউ দেশত্যাগ করছেন, বিদেশে পাচার করছেন বিপুল পরিমাণ অর্থ। ইভ্যালি ও ই-অরেঞ্জসহ আলোচিত ১৪টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে তদন্ত করে এমন অভিযোগ পেয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। বাকি প্রতিষ্ঠানগুলো হলো সিরাজগঞ্জ শপ, ধামাকা শপিং ডটকম, নিরাপদ ডটকম, আলাদিনের প্রদীপ, আলেশা মার্ট, কিউ-ডটকম, বুমবুম, আদিয়ান মার্ট, নিডস, দালাল, এসকে ট্রেডার্স ও মোটরস।এর মধ্যে ধামাকা শপিং গ্রাহকের ৫৯৮ কোটি টাকা নিয়ে পলাতক রয়েছে। যদিও প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ১১৭ কোটি টাকা পাচারের ‘প্রমাণও পেয়েছে’ সিআইডি। এ জন্য প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এসএমডি জসিম উদ্দিন চিশতিসহ তার স্ত্রী ও তিন সন্তান ও ধামাকা শপিংয়ের এক পরিচালক এবং চারটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করেছে তারা।ই-অরেঞ্জ নামের একটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের মালিকপক্ষ প্রতারণামূলকভাবে ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। প্রতিষ্ঠানটির মালিকদের কয়েকজন গ্রেপ্তারের পর এখন কারাগারে। আরেক মালিক পুলিশ কর্মকর্তা সোহেল রানা ভারতে আটক হয়েছেন। বিভিন্ন ছাড়ে পণ্য কিনতে এ প্রতিষ্ঠানে যারা টাকা দিয়েছিলেন তারা এখন চিন্তায় আছেন আদৌ টাকা ফেরত পাবেন কিনা।সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার আটক করা হয় ই-ভ্যালির চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিন ও এমডি মোহাম্মদ রাসেলকে। চটকাদার ছাড়ের মাধ্যমে সারাদেশে বিপুল পরিমাণ গ্রাহক তৈরি করে প্রতিষ্ঠানটি। তবে দীর্ঘদিন ধরেই গ্রাহকদের পাওনা পরিশোধ করতে পারছিল না তারা। গ্রাহকদের কয়েকশ কোটি টাকার পণ্য পাওনা থাকলেও ই-ভ্যালি কর্তৃপক্ষ তা দিতে কালক্ষেপণ করে আসছিলেন।গত বছরের জানুয়ারিতে রাজধানীর কলাবাগান এলাকা থেকে ই-কমার্সের নামে যাত্রা শুরু করে এমএলএম কোম্পানি এসপিসি ওয়ার্ল্ড এক্সপ্রেস। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আল আমিন প্রধানের নেতৃত্বে অন্য সহযোগীরা গত বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত মাত্র ১১ মাসে ২৬৮ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। গত বছরের ৩ ফেব্রুয়ারি আল আমিনসহ প্রতিষ্ঠানটির ছয়জন গোয়েন্দা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন। ওই ঘটনায় মামলা হয় এবং আল আমিনসহ ছয়জনকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। কিন্তু দুই মাসের ব্যবধানে জামিনে বেরিয়ে আবারও এসপিসির কার্যক্রম শুরু করেন আল আমিন প্রধান।জানা যায়, এর পরও থামেনি এসপিসির কার্যক্রম। বর্তমানে প্রায় পঞ্চাশ লাখের অধিক নিবন্ধনকারী রয়েছে এসপিসির। প্রতি অ্যাকাউন্ট বাবদ এসপিসিকে দিতে হয় ১২০০ টাকা। এর পর বলা হয়- প্রতিদিন ২০ সেকেন্ড করে ওয়েবসাইট ভিজিট করলেই গ্রাহক পাবেন ১০ টাকা। এর পর তিনজনকে অ্যাড করতে পারলেই মিলবে অতিরিক্ত টাকা। এ ক্ষেত্রে ১ জনকে যুক্ত করলে অর্থাৎ স্পনসর বোনাস ৪০০ টাকা।এসব প্রতিষ্ঠানই নয়, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন বিভাগীয় শহরগুলোয় ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে নানা ধরনের ই-কমার্স ও এমএলএম কোম্পানি। এসব প্রতিষ্ঠান গ্রাহকদের লাভের লোভ দেখিয়ে আকৃষ্ট করে অর্থ আত্মসাৎ করে আসছে। রাজধানীর মালিবাগ, মগবাজার, গুলশান, ফার্মগেট, হাতিরপুল, মতিঝিল, পল্টনে বেশি সক্রিয় এমএলএম প্রতিষ্ঠানগুলো। অনেক প্রতিষ্ঠানেরই একাধিক অফিস রয়েছে। ‘এক্সিলেন্ট ওয়ার্ল্ড’ নামক এমএলএম কোম্পানির প্রধান নির্বাহী আনোয়ার এইচ রয়েল রানা। ‘উইন লাইফ গ্লোবাল লিমিটেড’ পরিচালনা করছেন মো. মনিরুল ইসলাম কাইয়ুম। ‘ডেলি বাজার লিমিটেড’ নামের এমএলএম চালাচ্ছেন আমিনুল ইসলাম হৃদয়। ‘পাওয়ার লাইফ বিডি লিমিটেড’-এর কান্ট্রি ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন রেজাউল লতিফ রিপন। মালয়েশিয়াভিত্তিক ‘ইনফিনিটি’ পরিচালিত হচ্ছে গুলশান-১ এ জব্বার টাওয়ার থেকে। ‘এবি নিউট্রিক ইন্টারন্যাশনাল’ ঢাকার বায়তুল ভিউ টাওয়ার এবং চট্টগ্রাম থেকে পরিচালিত হচ্ছে। রাইন রাজ্জাক প্লাজায় ‘মর্ডার্ন এমএক্সএন লিমিটেড’ চালাচ্ছেন আলমগীর মতি। পল্টনভিত্তিক অনেকগুলো এমএলএম সক্রিয় থাকলেও ‘মিশন-১০’ নেটওয়ার্ক সবচেয়ে বড়। ‘ওয়াল মিশন’ পরিচালিত হচ্ছে বিজয়নগর স্কাইলার্ক সেন্টার থেকে। রাজধানীর মোতালেব প্লাজাসহ হাতিরপুলেই ৩০টির মতো এমএলএম কোম্পানির ব্যবসার কার্যালয় রয়েছে। এ ছাড়া এমিটাচ, এমলবিং, টিয়ানশি, ফরএভার, এক্সিলেন্ট ফিউচার, ডিএক্সএন, এবিনিউট্রিক, এডভান্স বাংলা, ডি কাসিক লাইভ, ডাহিসেন, ড্রিম টুগেদার, পিনাকল, এসএমএন গ্লোবাল, সানসু লাইফ, লাইফওয়ে বিডি, লাক্সার গ্লোবাল, এমওয়ে ভিনশন বেশি সক্রিয়। গত এক মাসে অন্তত ১০টি অনলাইন এমএলএম কোম্পানি বিপুলসংখ্যক গ্রাহকের কয়েকশ কোটি টাকা নিয়ে উধাও হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ইনসাফ সেভেন, টু-লাইক, গোল্ডরাশ, গোল্ড লাইন, বিন্দাসওয়ার্ক ডট কম, বিডি লাইক, ইফোর্ডবিডি, জিওনেস, লাইক এইচএমপি ওয়ার্ল্ড, টু-লাইক ওয়েব, বিডি ক্যাশ রিওয়ার্ডস, স্টারস ফেয়ার২৫.কম, ওয়ালমার্ট গ্রুপ, জিএসসিবিডি, ইউকে লাইকসহ অনেক কোম্পানি।বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, অর্ধেক দামে পণ্য বিক্রি, শতভাগ বা তার বেশি ক্যাশব্যাক, পণ্য ডেলিভারির অনেক আগে টাকা নিয়ে নেওয়া এগুলো প্রতরণা ছাড়া আর কিছু নয়। অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, একটা পর্যায়ে গ্রাহক ঠকানো এ ধরনের প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারদের গ্রেপ্তার করা হয়। কিন্তু সেসব প্রতিষ্ঠান দ্বারা তিগ্রস্ত কেউই তাদের বিনিয়োগ করা অর্থ ফেরত পাননি। এখানে আইন প্রয়োগ হয় ঠিকই, তবে সেটা যথা সময়ে নয়। অনেক দেরিতে। ই-কমার্স প্লাটফরমে এ ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলো আলোচনায় এসেছে অনেক আগেই। অথচ, সঙ্গে সঙ্গে সরকার ব্যবস্থা গ্রহণ করলে এত বিপুলসংখ্যক গ্রাহকের আর্থিক ক্ষতি হতো না। দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনজীবী বিশেষ পিপি মীর আহম্মেদ আলী সালাম আমাদের সময়কে বলেন, গ্রাহকের টাকা ফিরে পাওয়া খুবই কঠিন ব্যাপার। কারণ প্রতারণা করে নেওয়া টাকা তো কোম্পানিগুলোর কাছে নেই। তাদের ফান্ডে একেবারে নগণ্য টাকা রয়েছে। এ জন্য অন্যান্য সম্পদও জব্দ করা হয়েছে। সব সম্পদ ও ফান্ডে থাকা টাকা দিয়েও গ্রহকের পাওনা সম্পূর্ণ টাকা ফেরত দেওয়া সম্ভব হবে না। কারণ পাওনা টাকার পরিমাণ জব্দকৃত টাকার চেয়ে অনেক বেশি।ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) জেনারেল ম্যানেজার জাহাঙ্গির আলম আমাদের সময়কে বলেন, উন্নত দেশে ই-কমার্স খাতে নজরদারি ও স্বচ্ছ প্রতিযোগিতা পর্যবেক্ষণের জন্য ফেয়ার ট্রেড কমিশন থাকে। কিন্তু আমাদের দেশে এ ধরনের কোনো কমিশন নেই। আমাদের প্রতিযোগিতা কমিশন রয়েছে। কিন্তু এটির ক্ষেত্র সীমিত। তা ছাড়া সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যেও সমন্বয়হীনতা রয়েছে। তিনি আরও বলেন, এর জন্য ডিজিটাল কমার্স নীতিমালায় ‘রিস্ক ফ্যাক্টর ম্যানেজমেন্ট কমিটি’র বিষয়টি ই-ক্যাবের পক্ষ থেকে প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু এতদিনেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। এ কমিটি থাকলে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নজর রাখা সহজতর হবে। তা ছাড়া ই-ক্যাবের কাছে কোন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান কত টাকা লেনদেন করছে সে বিষয়ে কোনো তথ্য থাকে না। তথ্য থাকলে সন্দেহজনক প্রতিষ্ঠানগুলোর আগে থেকে চিহ্নিত করা যেত। অপরদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোকে তার সম্পদের ওপর ভিত্তি করে কত টাকা বাকি রেখে লেনদেন করতে পারবে তা বেঁধে দিতে পারে।

SHARE