বিশেষ প্রতিনিধিঃ
পুরান ঢাকায় একের পর এক ঘটছে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। চুড়িহাট্টার অগ্নিকাণ্ডের পর আতঙ্ক বেড়েছে। এরমধ্যেই ঘটে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের আরেক ঘটনা। শনিবার দিবগাত রাতে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে প্রায় ২৫টি দোকান, কারখানা। জেএন সাহা রোডের ওই ছয় নম্বর গলির মার্কেটের পাশেই বাসা-বাড়ি। গলির আরেক পাশে স্কুল। বিভিন্ন দোকান। ভয়াবহ আগুনে দোকান, কারখানা পুড়ে প্রায় দুই কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
গতকাল ওই মার্কেটে গিয়ে দেখা গেছে, সানরাইজ ইন্টারন্যাশনাল প্রি ক্যাডেট স্কুলের গেটে, দু’তলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে শিশুরা। তাদের চোখে-মুখে আতঙ্ক। রাস্তার ওপারে ভস্মীভূত মার্কেটের দিকে তাকিয়ে আছে তারা। মার্কেটের গেট বন্ধ। গেটের সামনে কৌতূহলী মানুষ। ভেতরে কি হয়েছে জানার ইচ্ছে তাদের। এখানে কেন দাঁড়িয়ে আছেন জানতে চাইলে এক বৃদ্ধা বলেন, আগুন সব শেষ করে দেয়। এই আগুন কতজনকে শেষ করছে কে জানে। দেখতে আসছি, আগুনে কি ক্ষতি হয়েছে।
আগুনের ভয়াবহ বর্ণনা অনেকের মুখে মুখে। তাদেরই একজন শিক্ষিকা রেহানা। তার বাসার সামনেই মার্কেট। বাসা থেকে মার্কেট হয়েই যেতে হয় প্রধান সড়কে। মেয়েকে রিকশায় তুলে দিতে বাসা থেকে বের হন তিনি। ঘড়িতে তখন রাত ৯টা ৩৪ মিনিট। এরমধ্যেই দেখতে পান আগুনের শিখা। বিকট কয়েক শব্দ হলো। তারপর আগুন ছড়িয়ে গেল পুরো মার্কেটে। আতঙ্কগ্রস্ত মানুষ দৌড়াতে থাকলো। চারদিকে তখন ‘আগুন আগুন’ চিৎকার। কান্নার শব্দ। দ্রুত সবাইকে বাসা থেকে বের করে নিরাপদ স্থানে যেতে বলেন রেহানা।
নিজেদের জান-মাল রক্ষার জন্য এগিয়ে যান আশপাশের লোকজন। তারা পানি ছিটাতে থাকেন। খবর পেয়ে দ্রুত ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন। ফায়ার সার্ভিসের সাতটি ইউনিট সেখানে উপস্থিত হয়ে ৪০ মিনিট চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণ করে।
ওই গলির আরেক বাসিন্দা নুরুজ্জামান জানান, তিনি গলিতে হাঁটাহাঁটি করছিলেন। এরমধ্যেই দেখতে পান আগুন। শুরুতে আগুনের তীব্রতা কম ছিলো। এ সময় অনেকেই দোকান থেকে কিছু জিনিস সরাতে পেরেছেন। এমনকি গ্যারেজে রাখা একটি সিএনজি অটোরিকশাও সরানো সম্ভব হয়েছে। পাঁচ-সাত মিনিট পরেই তা ভয়াবহ আকার ধারণ করে।
এ সময় বিকট শব্দ হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল গ্যাসের সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ঘটছে। তাৎক্ষণিকভাবে আশপাশের লোকজন পানি ঢেলে আগুন নেভাতে চেষ্টা করে বলে জানান তিনি।
গতকাল সেখানে গিয়ে দেখা গেছে, গলির পিচঢালা রাস্তাটি তখনও পানিতে ভিজে আছে। বাতাসে পুড়া গন্ধ। গেটের ভেতরে ঢুকতেই দেখা যায় আগুনে পুড়ে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন পণ্য, কাঠ, টিন, ছুরি, ক্যাবল, আসবাবপত্র। পুড়েছে তিনটি সিএনজি অটোরিকশাও। সেমিপাকা এই মার্কেটে ওয়ালটনের শো রুম, ইলেকট্রনিকস, ওয়ার্কশপ, সেলুন, ভাঙাড়ি, কুটির শিল্পসহ বিভিন্ন ধরনের দোকান ছিলো ১২টি। টিভির ট্রলি, শেভিং ব্রাশ, ছুরি তৈরিসহ বিভিন্ন ধরনের কারখানা ছিলো সাতটি। এ ছাড়াও অন্যান্য দোকান মিলিয়ে প্রায় ২৫টি দোকান। প্রতিটি দোকানই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। আগুনে পুড়ে বাদামি হয়ে পড়ে আছে তিনটি সিএনজি অটোরিকশা। ছুরির কারখানায় পড়ে আছে সিলিন্ডার। জানা গেছে, অন্তত পাঁচটি সিলিন্ডার ছিল মার্কেটে। এ ছাড়াও তিনটি সিএনজি অটোরিকশায় ছিল আরো তিনটি সিলিন্ডার।
ওই মার্কেটের মালিক আতাউর রহমান বাবু। তার ছোটভাই ব্যবসায়ী মাহমুদুর রহমান সেলিম জানান, মার্কেটে কেমিক্যাল গোডাউন ছিল না বলেই আগুন আধা ঘণ্টার মধ্যে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছে। তবে কয়েক সিলিন্ডার ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, সিলিন্ডারগুলো ছুরি জোড়া দেয়ার কাজে ব্যবহার করা হতো। এগুলো তেমন ভয়াবহ ছিল না। সেলিম জানান, অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি এড়াতেই তারা কম টাকায় দোকানগুলো ভাড়া দেন। এই ঘরগুলো কেমিক্যাল ব্যবসায়ীদের কাছে ভাড়া দিলে কয়েক গুন বেশি টাকা পাওয়া যেত। তারপরও এই অগ্নিকাণ্ডে অনেক ক্ষতি হয়েছে। কীভাবে আগুনের সূত্রপাত এ বিষয়ে স্পষ্ট কিছু জানাতে পারেননি তিনি। তবে তার ধারণা শর্টসার্কিট থেকেই আগুনের উৎপত্তি।
সেলিম জানান, রাতে মার্কেটে কম লোকজনই থাকে। কাজ শেষে রাত ৯টার পরে তারা বাইরে বেড়াতে যায়। এরমধ্যেই আগুনের ঘটনা ঘটে। যে কারণে হতাহতের কোনো ঘটনা ঘটেনি।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহামেদ খান জানান, খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের সাতটি ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে প্রায় চল্লিশ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণ করে। তবে আগুনের সূত্রপাত এখনো জানা যায়নি বলে জানান তিনি।
উল্লেখ্য, গত ২০শে ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ১০টার দিকে পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টা মসজিদের সামনে বিস্ফোরণ থেকে এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ওই আগুনে নারী-শিশুসহ ঘটনাস্থলেই কমপক্ষে ৬৭ জন নিহত হন। চুড়িহাট্টায় কেমিক্যাল গোডাউন, বডি স্প্রে, স্যান্ডেল ও প্লাস্টিকের বেশ কয়েক কারখানা ছিল। তারপর থেকেই পুরান ঢাকার বাসিন্দাদের মধ্যে আগুন আতঙ্ক বিরাজ করছে।