অনলাইন ডেস্ক: ভোলানিউজ.কম,
শিকড়ের সন্ধানে দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টা অবশেষে সফল হয়েছে সাজেদার। ৪০ বছর পর শিকড়ের সন্ধান পেয়ে নেদারল্যান্ডস থেকে স্বামী-সন্তানসহ গফরগাঁওয়ের খারুয়া মুকন্দ গ্রামের বাড়িতে ফিরে এলেন সাজেদা। তাকে দেখতে প্রতিদিন শত শত মানুষ ভিড় করছে ওই বাড়িতে।
আজ থেকে ৪০ বছর আগে গাজীপুরের টঙ্গী স্টেশনে একটি ট্রেনের ভেতর অভিভাবকহীন পাওয়া যায় দুই শিশুকন্যাকে। তাদেরই একজন সাজেদা। অন্যজনের নাম মল্লিকা। তাদের বাবা-মা এখন আর বেঁচে নেই।
জানা যায়, ট্রেন থেকে উদ্ধারের পর ভাগ্যাহত সাজেদা ও মল্লিকার আশ্রয় হয় মাতৃসদনে। পরে সেখান থেকে তাদের আশ্রয় মেলে নেদারল্যান্ডসের দুই দম্পতির ঘরে।
গতকাল সোমবার সাজেদা নেদারল্যান্ডসের নাগরিক স্বামী থমাস ও দুই পালিত কন্যা আজিয়া ও মুনকে নিয়ে ইত্যাদির একটি টিমের সহযোগিতায় গফরগাঁও উপজেলার রাওনা ইউনিয়নের খারুয়া মুকন্দ গ্রামের জন্মভূমিতে আসেন।
পরিবারের ভাষ্য, ১৯৭৮ সালে সাজেদা ও মল্লিকার বয়স ছিল ৬-৭ বছরের মতো। অভাবের সংসারে তাদের খাবার জোগানোর সামর্থ্য ছিল না বাবা-মায়ের। হতভাগ্য দুই বোনকে গফরগাঁও রেলস্টেশনে অপেক্ষমাণ একটি ট্রেনের ভেতর রেখে আসেন তারা। তারপর থেকে নিখোঁজ শিশু দুই বোন। ৪০ বছর পর বাড়ির সন্ধান পেলেন ছোট মেয়ে সাজেদা। ফিরে পেয়েছে আপনজনদের।
সাজেদা ও মল্লিকার মাতৃসদনে আশ্রয় জোটার বিষয়ে জানা যায়, গাজীপুরের টঙ্গী স্টেশনে ময়মনসিংহ থেকে আসা একটি ট্রেনের যাত্রাবিরতিকালে দুই শিশুর কান্নার আওয়াজ শুনে স্থানীয় এক ব্যক্তি তাদের উদ্ধার করেন। পরে তিনি দত্তপাড়ায় অবস্থিত একটি মাতৃসদনে ভর্তি করে দেন তাদের। সেখানে কেটে যায় দুই বছর। এ সময়ে তারা বাড়ির কোনো কথাই মনে করতে পারেনি।
১৯৮০ সালে নেদারল্যান্ডসের এভার্ট বেকার ও মেরিয়ান্ট রেজল্যান্ড দম্পতি বাংলাদেশ সফর করছিলেন। তারা টঙ্গীর ওই মাতৃসদন থেকে শিশু মল্লিকাকে দত্তক নেন। ওই দম্পতির মাধ্যমে নেদারল্যান্ডসের আরেকটি পরিবার মল্লিকার ছোট বোন সাজেদাকে দত্তক নিয়ে যায়। সেখানেই সাজেদা ও মল্লিকা বড় হন।
সাজেদা নেদারর্যান্ডসে নার্সিংয়ে ¯œাতক ডিগ্রি নিয়ে একটি হাসপাতালে সেবিকার কাজ করেন। সে দেশের এক নাগরিক থমাসের সঙ্গে বিয়ে হয় সাজেদার। তাদের সুখের সংসারে রয়েছে দুই কন্যাসন্তান।
দত্তক নেয়ার সময় দুই বোনের মাতৃভূমি বাংলাদেশ, এ তথ্য দত্তক নেয়া পরিবারের জানা থাকলেও তাদের বাবা-মা কিংবা অন্য কোনো পরিচয় জানা ছিল না। বড় হয়ে সাজেদা বেশ কয়েকবার বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে তার মা-বাবার সন্ধান করে ব্যর্থ হন। প্রতিবারই টঙ্গী ও আশপাশের এলাকায় পোস্টারিং ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করে কোনো ফল না পেয়ে হতাশা নিয়ে ফিরে যান।
এ বছর জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশে এসে বাবা-মা, স্বজনদের খোঁজে ব্যর্থ হয়ে অবশেষে যোগাযোগ করেন বিটিভির ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ইত্যাদির পরিচালক হানিফ সংকেতের সঙ্গে। গত ৩০ মার্চ এ-সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন ইত্যাদিতে প্রচারিত হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
অনুষ্ঠানটি দেখে খারুয়া মুকুন্দ গ্রামের দলিল লেখক শ্যামল কুমার দত্ত ইত্যাদির পরিচালক হানিফ সংকেতের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ছুতু মিয়া (৫৫) ও ছুলেমান নেছা (৬০) নামের দুজনের ডিএনএ রিপোর্ট নেদারল্যান্ডসে পাঠান। সাজেদা নিশ্চিত হন ছুতু মিয়া ও ছুলেমান নেছা তার ভাই-বোন।
গতকাল সোমবার সাজেদা নেদারল্যান্ডসের নাগরিক স্বামী ও দুই কন্যাসন্তান নিয়ে ইত্যাদির একটি টিমের সহযোগিতায় গফরগাঁও উপজেলার রাওনা ইউনিয়নের খারুয়া মুকন্দ গ্রামের জন্মভূমিতে যান। এ সময় এক আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। বড় বোন ছুলেমন নেছা ও ভাই ছুতু মিয়া হারিয়ে যাওয়া বোনকে জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘৪০ বছর পর বোন ফিইরা আইছে। এত দিন ভাবছিলাম বোনডা আমাদের মইরা গেছে। ওরে পাইয়া এখন কইলজাডা ঠান্ডা অইয়া গেছে।’
তবে সাজেদা এখন আর বাংলা বলতে পারেন না। ভাই-বোনের কথা বুঝতে না পারলেও তাদের বুকে আশ্রয় নেন তিনি। পরে সাজেদা তার বাবা-মার কবর জিয়ারত করেন।
আত্মীয়-স্বজন ও আশপাশের গ্রামের হাজারো মানুষ দুই দিন ধরে সাজেদাকে দেখতে আসছে। তাদের পরিবারে এখন উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে।
কথা বলতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন সাজেদার ভাই ছুতু মিয়া। তিনি বলেন, ‘বহুত বছর পর বোনেরে পাইছি। কিন্তু আব্বা তার মেয়েরে দেখে যেতে পারল না। আব্বা বেঁচে থাকলে এহন সবচেয়ে বেশি খুশি হতেন।’
রাওনা ইউপি চেয়ারম্যান সাহাবুল আলম বলেন, সাজেদার আগমনে সারা গ্রামে এখন আনন্দের জোয়ার বইছে। তাকে দেখার জন্য প্রতিদিন শত শত মানুষ ভিড় করছে। পরিবারের সাধ্যমতো বাড়িতে আসা মানুষজনকে আপ্যায়নের চেষ্টা করছে তারা।
(আল-এম, ১৭জুলাই-২০১৮ই)