শেখ হাসিনা সরকারের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপদেষ্টা, হুইপ, এমপি, সচিব ও পুলিশ কর্মকর্তারা সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। এমন অন্তত ১০০ জনের একটি প্রাথমিক তালিকা তৈরি করেছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) গোয়েন্দা ইউনিট। এই তালিকা অনুযায়ী অর্ধেকের বেশি ব্যক্তির বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে সংস্থাটির বিশেষ তদন্ত শাখা।
তালিকা অনুযায়ী সম্পদের পাহাড় গড়া উপদেষ্টাদের মধ্যে আছেন- সাবেক প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিক এবং বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। মন্ত্রীদের মধ্যে আছেন- সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী, অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী, নৌ-পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান ফিজার, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী আবদুর রহমান, রেলমন্ত্রী মো. জিল্লুল হাকিম, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম, সমাজকল্যাণ মন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু বিষয়ক মন্ত্রী শাহাব উদ্দিন, নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ, শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী, ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু। এরই মধ্যে তাদের বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। দুদক সূত্র জানায়, সাবেক এই মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের মধ্যে অন্তত ১০ জনের বিদেশে বাড়ি থাকার তথ্য পাওয়া গেছে।
সাবেক এমপিদের মধ্যে নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন, সাইফুজ্জামান শিখর, সাবেক হুইপ সামশুল হক চৌধুরী, নজরুল ইসলাম বাবু, ইকবালুর রহিম, মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী, বেনজীর আহমেদ, মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী, মাহফুজুর রহমান মিতা, নাছিমুল আলম চৌধুরী ওরফে নজরুল, আয়শা ফেরদৌস, রণজিত কুমার রায়, জাকির হোসেন, হাবিব হাসান, অ্যাডভোকেট নূরুল ইসলাম তালুকদার, আবদুল ওদুদ, নিজাম উদ্দিন হাজারী, এনামুল হক, নাঈমুর রহমান দুর্জয়, শওকত হাচানুর রহমান রিমন, আনোয়ারুল আশরাফ খান ওরফে দিলীপ, সাদেক খান, গোলাম ফারুক খন্দকার প্রিন্স, আকতারুজ্জামান বাবু, শফিকুল ইসলাম শিমুল, তানভীর ইমাম, সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার ওরফে সেলুন, শাহে আলম তালুকদার, ডা. মনসুর রহমান, মো. আবুল কালাম আজাদ, ধীরেন্দ্র নাথ শম্ভু, জান্নাত আরা হেনরী, অসীম কুমার উকিল ও তার স্ত্রী যুব মহিলা লীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ও সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি অপু উকিলের বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী এবং সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের ছেলে তমাল মনসুরের বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান চলছে। সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ, ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া এবং ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সাবেক প্রধান ডিআইজি হারুন অর রশীদের বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক। সর্বশেষ গত ২০ আগস্ট হারুনের তথ্য চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক, সাব রেজিস্ট্রি অফিস, পাসপোর্ট, নির্বাচন কমিশনসহ অর্ধশতাধিক প্রতিষ্ঠানে চিঠি পাঠিয়েছে সংস্থাটি। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সাবেক প্রধান মোহাম্মদ আলী মিয়া এবং বরিশাল রেঞ্জের সাবেক ডিআইজি জামিল হাসানের বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে। অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ এনে পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত ডিআইজি গাজী মো. মোজাম্মেল হক ও তার স্ত্রী ফারজানা মোজাম্মেলের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা চেয়ে গত ২০ আগস্ট দুদকে আবেদন করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. লুৎফর রহমান। গত ১৩ মে পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চে (এসবি) কর্মরত অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ রফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগের অনুসন্ধান শুরুর সিদ্ধান্ত নেয় দুদক। গত ২৫ আগস্ট জ্ঞাত আয়-বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব কবির বিন আনোয়ারের বিরুদ্ধে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব শাহ কামাল এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের দ্বিতীয় সচিব (মূসক মনিটরিং, পরিসংখ্যান ও সমন্বয়) আরজিনা খাতুন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক উপ-প্রেস সচিব আশরাফুল আলম খোকন এবং এপিএস-২ গাজী হাফিজুর রহমান লিকুর বিরুদ্ধেও অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক। গত ১৯ আগস্ট রাজধানীর সেগুনবাগিচায় নিজ কার্যালয়ে দুদক সচিব খোরশেদা ইয়াসমীন সাংবাদিকদের বলেন, সাবেক মন্ত্রী-এমপিদের মোট ৪১ জনের দুর্নীতির একটি তালিকা আমরা পেয়েছি। এটি এখন যাচাইবাছাই কমিটির কাছে আছে। দুদক সূত্র বলছে, ওই এমপি-মন্ত্রীদের অনুসন্ধানের বিষয়ে তিনজন পরিচালকের নেতৃত্বে পৃথক তিনটি টিম গঠন করা হয়। বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ পাওয়া গেছে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধেও। এর মধ্যে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. সৌমিত্র শেখর, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য মুনাজ আহমেদ নুর, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ ও তার পিএস ডা. রাসেলের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক। সংস্থাটির কর্মকর্তারা বলছেন, জগন্নাথ বিশ্ববিদালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমানেরও বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে তার কাঁটাবনে ৩ হাজার বর্গফুটের বিলাসবহুল ফ্ল্যাট, গ্রামের বাড়ি কুমিল্লায় কয়েক কোটি টাকার ডুপ্লেক্স বাড়ি এবং নামে-বেনামে আরও অনেক সম্পদ পাওয়া গেছে। তার বিরুদ্ধে শিক্ষক নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া পিরোজপুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. কাজী সাইফুদ্দীনের বিরুদ্ধেও নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে। তার বিরুদ্ধে ২০০৮ সালে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক পদে নিয়োগ নেওয়ার সময় জাল-জালিয়াতির অভিযোগের তথ্য পাওয়া গেছে।
দুদক জানায়, লন্ডন, দুবাই, সিঙ্গাপুর ও তুরস্কে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচারের অভিযোগে এনএসআইয়ের সাবেক ডিজি টি এম জোবায়েরের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত হয়েছে। গত ২০ আগস্ট ঢাকা ওয়াসার সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খানের তথ্য চেয়ে বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে তার বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দিতে ইমিগ্রেশনে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
গতকাল তিনজনের দুর্নীতির অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুদক। এর মধ্যে ক্ষমতার অপব্যবহার, নানা অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে নিজ ও আত্মীয়স্বজনের নামে দেশে-বিদেশে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ পাওয়া গেছে চট্টগ্রাম-৩ আসনের সাবেক এমপি মাহফুজুর রহমান মিতা এবং কুমিল্লা-৮ আসনের সাবেক এমপি নাছিমুল আলম চৌধুরী ওরফে নজরুলের বিরুদ্ধে। এমপি হওয়ার পর তাদের প্রায় ২০০ শতাংশ সম্পদ বেড়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
দুদক সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম-৩ আসনের সাবেক এমপি মাহফুজুর রহমান মিতা ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনে তিনবার এমপি ছিলেন। ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন তিনি। ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দাখিল করা হলফনামায় তার বার্ষিক আয় ছিল ৪৭ লাখ ৫ হাজার ৮০৫ টাকা। গত ১০ বছরে তার আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৪ লাখ ৬৭ হাজার ৮২৪ টাকা, যা ২০১৪ সালের বার্ষিক আয়ের তুলনায় ১০১ দশমিক ২ শতাংশ বেশি এবং অস্থাবর সম্পদ বেড়েছে ১৯৯ দশমিক ২৩ শতাংশের বেশি। স্ত্রী মাহমুদা মাহফুজের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ বেড়েছে ১৯০ শতাংশের বেশি। আর দুদকের অনুসন্ধানে তাদের নামে ঢাকার অদূরে পূর্বাচলে প্লট, রাজধানীর মতিঝিলে ৫ কাঠা জমির ওপর নির্মিত বিল্ডিং, গুলশানে ফ্ল্যাট, উত্তরার দিয়াবাড়িতে ৫ কাঠা জমির প্লট, হারামিয়া সন্দ্বীপে জমি, বাড়ি এবং মাহফুজুর রহমান মানি এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে কোটি কোটি টাকা পাচার করেছেন বলে জানা গেছে।
এ ছাড়া কুমিল্লা-৭ আসনের সাবেক এমপি নাছিমুল আলম চৌধুরী ওরফে নজরুলের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে। দুদকের তথ্যানুসন্ধানে তার নিজ নামে বিজে জিও টেক্সটাইল লিমিটেড নামে একটি কোম্পানিতে ১ কোটি ৫৭ লাখ ৭৫ হাজার টাকা বিনিয়োগ, ঢাকার বনানী ডিওএইচএস ও নিকুঞ্জে ২টি ফ্ল্যাট, কুমিল্লার বরুড়া বাজারে ১৭টি দোকান, কুমিল্লা সদরে ঠাকুরবাড়ি ও ঝাউতলায় ২টি বহুতল বাড়ি এবং নামে-বেনামে প্রায় ৪৫০ শতাংশ জমি থাকার তথ্য পাওয়া গেছে।
দুদক জানায়, যশোর পৌরসভার সাবেক মেয়র জহুরুল ইসলাম চাকলাদার ওরফে রেন্টু চাকলাদার ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন। তিনি ২০১৬ সালে যশোর পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হন। মেয়র নির্বাচিত হওয়ার আগে নিজের বা পৈতৃকভাবে উল্লেখ করার মতো সম্পদ ছিল না। কিন্তু মেয়র হওয়ার পর তিনি অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন। ২০১৮ সালে একই সময়ে শহরে ৭২টি রাস্তাঘাট নির্মাণ এবং শহরে বাতি স্থাপনে ব্যাপক অনিয়ম করেছেন। তিনি শহরের জলাবদ্ধতা দূরীকরণে ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনা ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় অনিয়ম করে প্রায় ৪০ একর জমি আত্মসাৎ করেছেন। যশোর শহরের আরাবপুরে প্রায় ১০০ বিঘা জমির ওপর বিশাল বাগানবাড়ি, যশোর শহরের রূপদিয়া বাজারে ২০ বিঘা জমির ওপর একটি ফিড মিল, শহরের কাজিপাড়ায় সুদৃশ্য অট্টালিকা নির্মাণ করেছেন। তিনি যশোরের বাঘারপাড়ার একাধিক স্কুল-কলেজের সভাপতি হয়ে নিয়োগ বাণিজ্যের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন।
দুদকের গোয়েন্দা অনুসন্ধানে জানা যায়, রেন্টু ক্ষমতার অপব্যবহার, নানাবিধ অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে নিজ ও আত্মীয়-স্বজনের নামে দেশে-বিদেশে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন। তার অবৈধভাবে অর্জিত জ্ঞাত-আয় বহির্ভূত সম্পদ থাকার প্রাথমিকভাবে তথ্য-প্রমাণ পাওয়ায় প্রকাশ্য অনুসন্ধানের জন্য কমিশন সিদ্ধান্ত নিয়েছে।