ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বাসভবনে মধ্যযুগীয় কায়দায় নারকীয় তাণ্ডবের ঘটনায় ছাত্রলীগে অনুপ্রবেশকারী শিবির ও ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা জড়িত। একাধিক ভিডিও ফুটেজে তাদের ছবি উঠে আসছে, যা তদন্ত সংশ্লিষ্ট সংস্থার কাছে ইতোমধ্যে এসেছে। প্রত্যক্ষদর্শী ঢাকা কলেজের একজন ছাত্র। তিনি ইত্তেফাকের কাছে ওই ঘটনার পূর্ণ বিবরণ তুলে ধরে বলেন, পূর্ব পরিকল্পনামাফিক মিছিল নিয়ে এ হামলা চালানো হয়। হামলকারীদের হাতে ছিল আগ্নেয়াস্ত্র। এ কারণে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তাদের প্রতিহত করতে ব্যর্থ হয়ে পিছু হটেছিল।
ওই প্রত্যক্ষদর্শী আরো বলেন, ছাত্রলীগের সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ ও সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসাইন ভিসির বাসভবনে ছিলেন। তারা হামলাকারীদের ঠেকাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পারেননি। এক পর্যায়ে ঢাকা কলেজের সাহায্য চাওয়া হয়। পরে ঢাকা কলেজ শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীসহ অনেক সাধারণ শিক্ষার্থী ঘটনাস্থলে যান। কিন্তু ততক্ষণে ভিসির বাসভবনে ভয়াবহ তাণ্ডব চালিয়ে তারা চলে যান। একাত্তরেও ঢাবির ভিসির বাসভবনে এমন তাণ্ডব চালানো হয়নি।
সরকারের সর্বোচ্চ মহলের নির্দেশে ইতোমধ্যে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে ঘটনার তদন্ত শুরু হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন। নিকৃষ্ট এ হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়ে বুধবার সংসদে প্রধানমন্ত্রী বলেন, একাত্তরে হানাদাররা যেভাবে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে হামলা করে লুটপাট চালিয়েছিল, ঠিক একই কায়দায় ঢাবি’র উপাচার্যের বাসভবনে হামলা-লুটপাট করা হয়েছে। এত বড় অন্যায় আমরা কোনোভাবে মেনে নিতে পারি না। গোয়েন্দা সংস্থাদের নির্দেশ দিয়েছি, বিষয়টি তদন্ত করে দেখতে। জড়িতদের অবশ্যই বিচার হবে।
মহানগর গোয়েন্দা পুলিশকে ঘটনার মূল তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তদন্ত কমিটিতে মেধাধী, যোগ্য ও অভিজ্ঞদের নিযুক্ত করা হয়েছে। মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সিনিয়র কর্মকর্তারা তদন্ত কার্যক্রম মনিটর করছেন। পুলিশ সদর দপ্তরের পক্ষ থেকেও অনুসন্ধান করা হচ্ছে। তবে তাদের এই অনুসন্ধানের উদ্দেশ্য মূল তদন্ত কমিটিকে সহযোগিতা করা। এছাড়া র্যাবের পক্ষ থেকে এবং তিনটি গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকেও মূল তদন্ত কমিটিকে সহযোগিতা করা হচ্ছে। জানা গেছে, নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত হামলাকারীদের গ্রেফতার করা হবে। অযথা কাউকে হয়রানি করা হবে না। ইতোমধ্যে সেখানে হামলার ভিডিও ফুটেজ, মিছিল নিয়ে কারা গিয়েছিল তাদের অনেককে শনাক্ত করেছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। এদিকে কোটাব্যবস্থা নিয়ে মুখ খুলেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি এ নিয়ে বুধবার রাতে লন্ডন থেকে টেলিফোনে কথা বলেছেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য ও জাতীয়তাবাদী সাংস্কৃতিক সংসদ (জাসাস) সভাপতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মামুন আহমেদের সঙ্গে। যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। এতে দেখা যায়, এ কথোপকথনে অনেক উসকানিমূলক বক্তব্য ছিল তারেক রহমানের। ওই কণ্ঠস্বর যে তারেক রহমানের ইতোমধ্যে সেটি নিশ্চিত হয়েছে তদন্ত কমিটি। এছাড়া তারেক রহমান কোটা আন্দোলন নিয়ে কোনো সংগঠন কিংবা নেতাকর্মীর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানান তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা।
পুলিশের মহাপরিদর্শক জাবেদ পাটোয়ারী ইত্তেফাককে জানান, তদন্ত শুরু হয়েছে। সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত হচ্ছে। অযথা কাউকে হয়রানি না করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া ইত্তেফাককে জানান, সর্বোচ্চ অভিজ্ঞ ও মেধাসম্পন্নদের দিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে বিষয়টির তদন্ত করা হচ্ছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ইাতোমধ্যে অনেক প্রমাণ সংগ্রহ করেছেন। আরও প্রমাণ সংগ্রহের কাজ চলছে। চাক্ষুষ সাক্ষীর জবানবন্দি নিয়েছে। হামলাকারীরা শুধু সিসি টিভি খুলে নেয়নি, হার্ড ডিস্কটাও খুলে নিয়েছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে আরও সিসি টিভি আছে, মিডিয়ার ফুটেজ আছে।
অনুসন্ধানে বের হয়ে আসছে, নানা কৌশলে ছাত্রলীগে ইতোমধ্যে অনুপ্রবেশ করেছে ছাত্রদল, জামায়াত ও শিবিরের নেতাকর্মীরা। বিভিন্নভাবে অপকর্ম করে তারা দলের দুর্নাম ছড়াচ্ছে। ছাত্রলীগের নাম ব্যবহার করে চাঁদাবাজি করছে তারা। এই দুষ্কৃতকারীদের একটি গ্রুপ মিছিল নিয়ে ভিসির বাসভবনে আক্রমণ করে। তবে এ হামলা একাত্তরের বর্বরতাকেও হার মানিয়েছে। ভিসির বেডরুম পর্যন্ত রক্ষা পায়নি। বাথরুমের কমোডও ভেঙেছে। সব তছনছ হয়ে গেছে। ভিসির পরিবারের সদস্যদের সোনার গহনা নিয়ে গেছে। ঘটনা সরেজমিন পরিদর্শন করে তদন্ত সংস্থার সংশ্লিষ্টরা হতবাক। প্রসঙ্গত, একাত্তরের ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চ লাইটের রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক হত্যাযজ্ঞ চললেও ভিসির বাসভবন সেদিন আক্রান্ত হয়নি। অথচ স্বাধীনতার ৪৭ বছর পর সেই ঘটনা ঘটল।