চাল নিয়ে চুলোচুলি — নেয়ামত উল্লাহ

নিউজ ডেস্কঃ প্রথম আলোর ভোলা প্রতিনিধি নেয়ামত উল্লাহ আজ তার ফেইজবুকে লিখেছেন চাল নিয়ে চুলোচুলি’র কথা। ভোলা নিউজ পাঠকদের জন্য তা তুলে ধরা হলো।

“”চুলোচুলি ঠেকাতে দেশের মানুষ যখন সমানে টাক হচ্ছে, ঠিক তক্ষুনি শুরু হয়েছে চাল নিয়ে চুলোচুলি। যত্রতত্র মিলছে ত্রানের চাল। করোনাভাইরাস দুর্যোগে বিশ্ব যখন বেসামাল, তখন আমরা চালমাতাল। তখনই দেশের সূর্য্যসন্তানেরা চালের দাম বাড়িয়ে দিলেন। যা এখনও নিয়ন্ত্রণে এলো না। শুনেছি, বিশ্বে করোনাকালে সব জিনিসের দাম কমছে, মাসাল্লাহ! আমরা সুযোগসন্ধানী জাতী চাল, ডাল, আদা, পেঁয়াজ আদা লবনসহ সব নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়াচ্ছি।

ঘরের চাল(ছাউনী) না থাকলেও হাড়িতে চাল-অর্থাৎ পেটে আহার চাই! চাল নিয়ে তাই চালাচালিও কম হচ্ছে না। রণে-ভনে, জলে-জঙ্গলে, আকাশে-পাতালে সবস্থানে চালবাজি। যারা ত্রানের ডিও কেনেন, তাদের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ। অনেকে বলছে, ভোলায় কেনো এতো ত্রানের চাল ধরা পড়ছে। কৃষকের হাতে ফসল থাকলে তার দাম নেই, ফরে-পাইকার বেপারীর হাতে গেলে আকাশচুম্বি দাম। ভোলাইয়ারা নাকি দুই পন্থায় ধনী হয়।
এক. চরের ধন, দুই. পরের ধন। আর এখন দুইয়ে যোগ হয়েছে ত্রানের ধন। চরের এবং পরের এটা সবাই জানেন। ত্রানেরটা নিয়ে একটু আলোচনা করি। ঝড়-বৃষ্টি, ভাঙন, চরাঞ্চলের নিত্যদিনের দুর্যোগ-দুর্ভোগ। এখন চলছে, করোনাকাল। ঘরবন্দী মানুষের দুর্ভোগ। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, দুর্যোগের কারণে ভোলার জনসংখ্যা বাড়ছে না। দুর্যোগের কারণে উদ্বাস্তু মানুষগুলো মাইগ্রেশন করছে। এই করোনাকালে আবার সেই মানুষ ফিরে এসেছে। তাই সংকট একটু বেশি।

ভোলায় ধানের ফলনও খুব বেশি। বছরে গড়ে দুই লাখ হেক্টরের বেশি জমিতে ধান উৎপাদন হচ্ছে। আবার ত্রাণও আসছে বেশ। আমাদের প্রধান খাবার ভাত। তারপরে রুটি-গম। আমরা কতো বড় হতভাগা! ধান আবাদ থেকে শুরু করে বিক্রয় তক্ নানা গল্পগাঁথা! সে গল্পে নাইবা গেলাম।
আমরা যদি বছরে একশ সংবাদ পরিবেশন করি। তারমধ্যে শতকরা দশভাগ চাল সংক্রান্ত। চাল বিতরণে অনিয়ম। ধান ক্রয়ে অনিয়ম। চাল পাচার, চাল পড়ছে ধরা। আমাদের ধান জেলার বাইরে যাচ্ছে । কম দামে। কৃষক কম দামে বিক্রি করছে। খরচ ওঠাতে পারছে না। সেই ধান চাল হয়ে বেশি দামে ভোলায় প্রবেশ করছে। সেই মাঝির ছেলে জজ হয়ে ফিরে আসার গল্পের মতো। কৃষককেই বেশি দামে চাল কিনতে হচ্ছে। খাদ্য বিভাগ এ ধান কিনছে, কৃষক বিক্রি করতে পারছে না। কারণ যখন কেনে, তখন কৃষকের ঘরে ধান থাকে না। ধান থাকলেও কৃষক বিক্রি করতে পারছে না। বিক্রি করছে, দলীয় লোকজন-দালাল শ্রেণির। যার ঘরে ধান নেই-সে খাদ্য বিভাগের খাতায় কৃষক। কারণ তার ভিটামিন ‘পি’ আছে। অতএব ভিটামিন ‘এম’ পেতে তার সমস্যা হয় না। দুইয়ে মিলে সমাজে ‘পিএম’দের জয়জয়কার। এমন নানান ধরণের সংবাদ।
একটা গল্প বলি, একবার এক চরে যাচ্ছি, এক লোক বললো, সে পেশায় কৃষক। তার চরে এক গুচ্ছগ্রামের ঠিকাদার ঘর বিতরনের নাম করে কৃষকদের সকল কৃষিকার্ড হাতিয়ে নিয়ে গেছে। প্রায় ৭০ টির মতো। ওই ঠিকাদার আবার ক্ষমতাসিন দলের নেতা। সে ওই কার্ড দিয়ে ওই এলাকার সকলের নামে খাদ্যগুদামে ধান সাপ্লাই দিয়েছে। কৃষক বিক্রি করেছেন ৫০০ তে, ওরা বারশ। আমি বলি সাবাশ! সাবাশ! ওই কৃষক বললো, সাবাশ না, কৃষকের পাছায় বাঁশ।

এই গুচ্ছগ্রামের মাটি ভরাটে বরাদ্দকৃত চাল। শতাধিক গুচ্ছগ্রাম। গত দুই বছরে গুচ্ছগ্রামে মাটির কাজে কয়েক হাজার মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ হয়েছে। এতো চাল! একই সঙ্গে আছে মৎস্যভিজিএফ, ভিজিডি, খাদ্যবান্ধব, টিআর। ঝড়-বৃষ্টির জিআর। কারণে-অকারণে ভোলায় এতো চালের চাহিদা নেই। তারপরেও চালের দাম কমে না। ধানের মতো ত্রানের এসব চাল চলে যায়-অন্য জেলায়। এই চাল নিয়ে প্রশাসন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও আমরা কত গল্প তৈরী করছি। চাল দেখলেই টাল হয়ে যাই। কি সরকারি চাল পাচার হচ্ছে! আটক। আবার ছাড়। কি হলো! এটা গুচ্ছগ্রামের চাল। এ চাল বিক্রি করতে পারবে। তাহলে ধরলো কেনো। এ প্রশ্নের উত্তর কেউ দেয় না। দুদিন পর পর এমন নাটক হচ্ছে।
আরও একটা গল্প বলি, সরকার মিলের নিকট চাল কিনেছে । কিন্তু উৎপাদন করে চাল দিলে দ্রুত সময়ে এতো চাল দেওয়া সম্ভব না। তাই বাজার থেকে কম দামের চাল কিনে গুদামের প্যাকেটে ভরে গুদামে ভরে দেওয়া হচ্ছে। সেই চাল বরাদ্দ দেওয়া হলো গুচ্ছগ্রামে। গুচ্ছগ্রামের বরাদ্দকৃত চালের ছাড়পত্র কেনে চাল ব্যবসায়ী; সেই চাল আবার বাজারে। সরকারি বস্তায় চাল বাজারে ছাড়লে খাচ্ছে ধরা। তাই অনেকে আবার ব্রান্ডের প্যাকেটে চাল ভরে বাজারে ছাড়ছে। সেখানেও খাচ্ছে ধরা। ধরাধরির শেষ নেই।

ভোলায় ত্রানের চাল নিয়ে এতো চুলোচুলির প্রধান কারণ এক ত্রানের মধ্যে আরেক ত্রানের জট। গরীব-দুখীর কোনো তালিকা নেই। ইউনিয়নের জনপ্রতিনিধিরা এলাকার গরীব-দুখী চেনে না। যে এসে সুবিধা দেয়, সেই হয়ে যায় গরীব-দুখী। ইউপি সদস্যরা স্বজনপ্রীতি করে নামে-বেনামে ত্রানের কার্ড করছে। অনেক সচ্ছল পরিবারের নামে খাদ্যবান্ধব রেশন কার্ড। তিনি চাল উত্তোলণ না করে, স্বাক্ষর বেচে দেন। আগে একটি ওয়ার্ডের অসহায়দের তালিকা করা দরকার। যদি গরীব-দুখীর তালিকা ইউনিয়ন পরিষদের সামনে টানানো থাকতো, তাহলে জবাবদিহিতা বৃদ্ধি পেত।
জেলেদের প্রায় বলতে শোনা যায়, প্রকৃত জেলেরা চাল পাচ্ছে না। অপ্রকৃত কারা! অন্য পেশার লোকজন। এখানেও অনিয়ম। ভাঙন কবলিত উদ্বাস্তু কারা! সেখানেও তালিকা নেই। প্রত্যেক তালিকায় অনিয়ম। আর সে কারণে জনপ্রতিনিধিরা ত্রানজট লাগাতে ওস্তাদ। এই জনপ্রতিনিধিদের মনে সব সময়, একটা গান ভেসে ওঠে, ‘এই ত্রানকে নিয়ে যাব-আরেক ত্রানের কাছে’। যদি তিনটি ত্রানের জট লাগাতে পারে, তাহলে দুটি লোপাট করা সহজ হয়ে যায়। এ ত্রান বিতরণে একজন তদারক কর্মকর্তা নিয়োগ হয়। তিনি ঐশ্বিরিকভাবে পানির ভুমিকা পালন করে। যে পাত্রে ঢালেন, সে পাত্রের রঙ ধারণ করেন।
আবার ত্রান বিতরণে কোনো যাতায়াত খরচ নেই। থাকলেও সামান্য। বস্তা বিক্রি করতে পারবে, ওই বস্তায় সরকারি সিল থাকায় কিনতে সাহস পায় না। আমরা বার বার বলেছি, ইউনিয়ন পরিষদের গুদামে যদি ত্রান পৌছে দেওয়া যায়, তাহলে অর্ধেক দুর্নীতি বন্ধ হবে। এ ত্রান শহুরে গুদাম থেকে নিতে এসে ট্রাক পরিষদে না পাঠিয়ে বাজারে পাঠায়। আবার গুদাম কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজোস করে কাগজে-কলমে উত্তোলণ দেখালেও চাল গুদামেই জমা থাকে। এখানে নিয়মিত গুদাম পরিদর্শন হচ্ছে না। অনেক সময় এক বছরের খাদ্য আরেক বছরে ছাড় হচ্ছে। ইউনিয়ন পরিষদের গুদামে ঠিকাদারের মাধ্যমে চাল পৌছে দিলে লোপাটের সম্ভাবনা কমে আসবে।
সবচেয়ে ভালো পদ্ধতি সকল ত্রান বন্ধ করে দিয়ে ইউনিয়ন ও শহর পর্যায়ে রেশনিং কার্যক্রম চালু করা। যার দরকার সে কিনে আনবে। দেশের সকল পরিবারের প্রধান জনসংখ্যা অনুয়ায়ী রেশন কার্ড করতে পারবে।””
মনেউ
১৭.৪.২০

SHARE