ভোলা নিউজ ডেস্ক ঃ রাজধানীর লালবাগে ৩ সেপ্টেম্বর কিশোর গ্যাংয়ের হাতে খুন হয় বাক প্রতিবন্ধী শিশু মো. হাফেজ (১১)। এ ঘটনার দুই দিন পর ৬ সেপ্টেম্বর রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরে খুন হয় সানোয়ার হোসেন নামের এক তরুণ। এর আগে একই থানা এলাকার কয়লাঘাটে পায়ে পাড়া দেয়ার ঘটনায় স্থানীয় কিশোর গ্যাং সিফাত নামে ১২ বছর বয়সি এক শিশুকে হত্যা করে। এ ঘটনায় গ্রেপ্তারকৃত ৬ শিশু-কিশোর খুনের কথা স্বীকার করার পর তাদের কিশোর সংশোধন কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে। শুধু খুনই নয়, কিশোর গ্যাংয়ের হাতে যৌন হয়রানি, গণধর্ষণ, মাদক ও অস্ত্র চোরাচালান এবং চাঁদাবাজি-দখলবাজিসহ ভয়ংকর নানা অপরাধ অহরহ সংঘটিত হলেও প্রশাসনিক কাঠামো ও আইনগত জটিলতার কারণে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাচ্ছে না। সাজার ভীতি না থাকায় দিনে দিনে তারা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষে কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ করা রীতিমতো চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।উদ্বেগজনক এ পরিস্থিতিতে কিশোর গ্যাংয়ের লাগাম টানতে সরকার এবার হার্ডলাইনে যাচ্ছে। এ ধারাবাহিকতায় ইতোমধ্যেই বেশকিছু প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সন্তানের বিপথগামিতার জন্য দায়ী অভিভাবকদের আইনের আওতায় আনার কথাও ভাবা হচ্ছে। পাশাপাশি শিশু আইন সংশোধনের ব্যাপারেও চিন্তা-ভাবনা রয়েছে। বিশেষ করে অনূর্ধ্ব ১৮ বছর বয়সিদের শিশু হিসেবে গণ্য করার যে বিধান রয়েছে তা পরিবর্তনের বিষয়টিতে জোর দেওয়া হচ্ছে। বিষয়টি স্বীকার করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানান, শিশু হিসেবে গণ্য করার বয়সসীমা ১৮ বছরের নিচে করার চিন্তা-ভাবনা করছে সরকার। তিনি বলেন, ১৮ বছর বয়সে ছেলেমেয়েরা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যায়। তাই এই বিষয়টি চিন্তা করার সময় এসেছে। সরকারের নীতি-নির্ধারক মহল সূত্র জানায়, আইন সংশোধনের ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে বেশ কিছুটা সময় লাগবে। তাই এ সময়টুকু সরকার বসে থাকতে চাইছে না। এজন্য আইন সংশোধনের আগে শিশু-কিশোর অপরাধ দমনে বেশ কিছু প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণে শিগগিরই দেশব্যাপী সাঁড়াশি অভিযান শুরু করা হবে। একইসঙ্গে এদের গডফাদারদের বিরুদ্ধেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কঠোর ব্যবস্থা নেবে।র্ যাব-পুলিশের টহল টিম কিশোর গ্যাংয়ের অনাচার দেখামাত্রই সংশ্লিষ্টদের আটক করে থানায় নিয়ে যাবে। সেখানে তাদের জীবনবৃত্তান্ত লিপিবদ্ধ করা হবে। এরপর অভিভাবকদের ডেকে সন্তানদের বিপথগামিতার কারণ উলেস্নখ করে প্রথমবারের মতো বিশেষ বিবেচনায় মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেবে। আটক কিশোরদের প্রশ্রয়দাতা হিসেবে যদি কোনো সন্ত্রাসী, মাদক ব্যবসায়ী কিংবা রাজনৈতিক নেতার নাম পাওয়া যায়, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মুচলেকা প্রদানকারী ওইসব কিশোর ফের একই অপরাধ করলে এ বিষয়টি দ্বিতীয়বার অভিভাবককে জানানো অত্যাবশকীয় হবে না। এ ক্ষেত্রে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। অন্যদিকে সামাজিক যোগাযোগের অজুহাতে যেসব শিশু-কিশোর অসামাজিক কার্যক্রমে জড়িত, তাদের ওপর কঠোর নজরদারি করা হবে। কোনো অপরাধ সংগঠনের উদ্দেশ্যে কিশোর গ্যাং আগাম কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ করছে কিনা- এ ব্যাপারে তারা কোনো প্রস্তুতি নিচ্ছে কিনা- গোয়েন্দারা তা নিয়মিত মনিটর করবে। কোনো অপতৎপরতার ষড়যন্ত্র টের পেলেই সংশ্লিষ্টদের আটক করা হবে। সংশ্লিষ্টরা জানান, কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করে হত্যা, মাদক চোরাচালানের মতো বড় ধরনের অপরাধের পরিকল্পনা করছে। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রাইভেট গ্রম্নপে মাদক সেবন, মাদক ব্যবসা, চুরি-ছিনতাইয়ের পাশাপাশি পরিকল্পিত হত্যা, সহপাঠীকে অপহরণের পর মুক্তিপণ দাবি, এমন কী ধর্ষণের ঘটনার ছক আঁটছে। যা নিয়ন্ত্রণে অভিভাবকদের সচেতনতা সবচেয়ে বেশি জরুরি।অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অভিভাবকদের অসচেতনতা ও প্রশ্রয়ের কারণেই বেশিরভাগ কিশোর বিপথগামী হচ্ছে। তাই এ অপরাধের দায় অনেকটাই তাদের। শিশু-কিশোর সন্তানের অপরাধের দায়ভার অভিভাবকদের কাঁধে কিছুটা চাপিয়ে দেওয়া হলে, দেশে কিশোর অপরাধ অনেকটা কমবে বলে মনে করেন তারা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নেহাল করিম মনে করেন, শিশু-কিশোরদের বিপথগামিতা থেকে উত্তরণের উপায় হচ্ছে বাবা-মায়ের তীক্ষ্ন নজরদারি। অভিভাবকদের দুর্বল তত্ত্বাবধানের কারণে কিশোররা অপরাধের দিকে ঝুঁকছে। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান মনে করেন, কিশোর অপরাধের পেছনে শুধু পরিবার নয়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সামাজিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দায়বদ্ধতা রয়েছে। এ প্রসঙ্গে তিনি যায়যায়দিনকে বলেন, স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটি, এলাকাভিত্তিক সংগঠন, সবারই দায় রয়েছে। কেউই এ দায় এড়াতে পারে না। এটি কাটিয়ে উঠতে হলে সমাজের সব সংগঠনের সমন্বিত উদ্যোগ ও সদিচ্ছা দরকার। অনেকটা অভিযোগের সুরে জিয়া রহমান বলেন, ‘আমরা সবাই পপুলার কথা বলছি যে- এটা করা যাচ্ছে না, এটা করতে হবে, কিন্তু কেউ এটা বাস্তবায়নে এগিয়ে আসছে না।’ এদিকে পুলিশের আইজি বেনজীর আহমেদ কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার জন্য আইনের জটিলতা, জনবল এবং অবকাঠামোর অভাবকে দায়ী করছেন। এ প্রসঙ্গে কয়েক মাস আগে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘কিশোর অপরাধ করলে মোবাইল কোর্ট করা যেত, এখন হাইকোর্ট বলেছে না এটা করা যাবে না। মোবাইল কোর্ট করা যাবে না, নরমাল আদালতে বিচার করা যাবে না, জেলে রাখা যাবে না, রাখব কোথায়? বিচারে পাঠাবো কোথায়? কিশোর অপরাধ দমনের জন্য পরিবারকে দায় নিতে হবে বলে জানান পুলিশ প্রধান। প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে দন্ডবিধি ১৮৬০-এর ধারা ৮২ অনুযায়ী ৯ বছরের কম বয়স্ক কোনো ব্যক্তির অপরাধমূলক কাজকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয় না। ধারা ৮৩ অনুযায়ী ১২ বছর বয়স্ক কোনো কিশোরও যদি তার কাজের প্রকৃতি ও ফলাফল বুঝতে সক্ষম না হয়, তাহলে তাকেও অপরাধী বলে গণ্য করা হবে না। শিশু আইন ২০১৩-এর ৪ ধারা বিদ্যমান ‘অন্য কোনো আইনে ভিন্নতর যাহা কিছুই থাকুক না কেন, অনূর্ধ্ব ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত সব ব্যক্তি শিশু হিসেবে গণ্য হইবে।’ অর্থাৎ, দন্ডবিধি ও শিশু আইন পর্যালোচনা করে বলা যায় ৯ বছর (ক্ষেত্রবিশেষে ১২ বছর) থেকে ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার আগে কেউ অপরাধ করলে শিশু বা কিশোর অপরাধী হিসেবে বিবেচিত হবে।বিচার কার্যক্রমের যেকোনো পর্যায়ে আনুষ্ঠানিক বিচার কার্যক্রমের পরিবর্তে শিশুর পারিবারিক-সামাজিক, সাংস্কৃতিক-আর্থিক, মনস্তাত্ত্বিক পটভূমি বিবেচনাপূর্বক, বিরোধীয় বিষয় মীমাংসাসহ তার সর্বোত্তম স্বার্থ নিশ্চিতকল্পে বিকল্প পন্থা (ফরাবৎংরড়হ) গ্রহণ করার বিধান আছে। এছাড়া গ্রেপ্তার করার পর কোনো শিশুকে হাতকড়া বা কোমরে দড়ি বা রশি লাগানো, কোনো শিশুকে নিবর্তনমূলক আটকাদেশ-সংক্রান্ত কোনো আইনের অধীন গ্রেপ্তার বা আটক করা নিষেধ। শিশু আইন, ২০১৩-তে শিশুর প্রতি নিষ্ঠুরতা, শোষণ, অসৎ পথে পরিচালনাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য করা হয়।