মোঃ আশরাফুল আলম
সম্প্রতি একটি হাসপাতালের মূল ফটকের সামনে কয়েকজন রোগী হুইল চেয়ারে বসে থাকতে দেখা গেছে। তাদের সাথে হাসপাতালের ইউনিফর্ম পরা সেবাকর্মী এবং জিনিসপত্রের ব্যাগ দেখে ধারণা করা হয়েছে়, তারা হয় ভর্তি হতে এসেছেন, অথবা হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন।
কিন্তু হাসপাতালে নিয়মিত চেকআপের জন্য আসা মানুষের ভিড় এখন একেবারেই নেই।
বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে গত ২৬শে মার্চ থেকে চলছে সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটি। যে কারণে পরিবহনসহ সব ধরণের কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। যদিও স্বাস্থ্যসেবা, ব্যাংক এবং গণমাধ্যমের মত কয়েকটি খাত চালু রয়েছে।
স্বাস্থ্যসেবার অংশ হিসেবে সরকারি হাসপাতাল চালু আছে। বেসরকারি হাসপাতালের সমিতিরও দাবি তাদের হাসপাতাল চালু আছে।
কিন্তু বাস্তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে জরুরি বিভাগে ডাক্তার নার্স থাকলেও, হাসপাতালে অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা বসছেন না এবং তাদের প্রাইভেট প্রাকটিস বন্ধ রয়েছে, সে কারণে সাধারণ রোগ কিংবা ক্রনিক অর্থাৎ দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থতায় ভোগা রোগীর চিকিৎসা প্রায় বন্ধ রয়েছে। কিন্তু রোগবালাই তো থেমে নেই।
এমন পরিস্থিতিতে যারা দীর্ঘদিন ধরে ডায়াবেটিসসহ অন্যান্য রোগে ভুগছেন, তারা পড়েছেন বিপাকে।
কথা বলেছিলাম সোনালী ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা তারিকুজ্জামানের সঙ্গে, যার ৮০ বছর বয়েসী মা’ ডায়াবেটিসের রোগী। চিকিৎসা আটকে গেছে করোনার লকডাউনের কারণে। তিনি জানান এপ্রিলের ২১ তারিখে মায়ের চেকআপের ডেট ছিল, কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে বের হবার সাহসা করি নাই। কারণ ওখানে রোজ প্রচুর মানুষ আসে, আর যেহেতু বয়স্ক মানুষের ঝুঁকি বেশি তাই ঝুঁকি নেইনি।
এদিকে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরুর পর অনেক হাসপাতালে অন্য স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে আসা রোগী ভর্তিতে আপত্তি করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সাধারণ এবং ক্রনিক রোগের চিকিৎসা প্রায় বন্ধ বলেই চলে।বাংলাদেশে করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে।সেই সঙ্গে রোগ শনাক্তে নমুনা সংগ্রহ এবং করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসার জন্য হাসপাতালের সংখ্যাও বাড়াচ্ছে সরকার।
কিন্তু বিশেষায়িত বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে সেবা দেয়া কার্যত বন্ধ রয়েছে।
যদিও কিছু বেসরকারি হাসপাতাল দাবি করছে তাদের কার্যক্রম চলছে, কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি ভিন্ন।
এমনকি সরকারি হাসপাতালেও তেমন রোগী ভর্তি করা হচ্ছে না।
জরুরী বিভাগে ডাক্তার-নার্স থাকলেও, হাসপাতালের বহিঃর্বিভাগে কেউ থাকেন না বলেই চলে।
এদিকে সেবাদানকারী হিসেবে নার্সদের পিপিই এর প্রয়োজন। বাংলাদেশে এমনিতেই জনসংখ্যার অনুপাতে ডাক্তার ও সেবাকর্মীর সংখ্যা অনেক কম। বাংলাদেশে সরকারি হিসাবে রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের সংখ্যা মাত্র ১ লাখ ২ হাজার ৯২৭ জন। এছাড়া রেজিস্টার্ড নার্স রয়েছেন ৫৬ হাজার ৭৩৪ জন।
যে কারণে স্বাভাবিক সময়ে হাসপাতাল ও ক্লিনিকে রোগীর উপচে পড়া ভিড় দেখা যায় সব সময়। কিন্তু বর্তমান অবস্থায় সেবা নিয়ে চিকিৎসক ও রোগীদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ রয়েছে।
রোগীর অভিযোগ, হাসপাতালের জরুরী বিভাগেও তারা সেবা পাচ্ছেন না। সেই সঙ্গে বেসরকারি ক্লিনিক ও বহু হাসপাতাল বন্ধ রয়েছে।
আর, চিকিৎসক ও সেবাকর্মীদের অভিযোগ, অনেক সময় রোগীরা তথ্য গোপন করে হাসপাতালে ভর্তি হতে আসেন, যে কারণে তারা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারেন এমন ভীতি রয়েছে তাদের।
আমি বেশ কয়েকজন চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলেছি, যারা এমন ভীতির কথা আমাকে বলেছেন, কিন্তু তারা ‘অন-রেকর্ড’ মন্তব্য করতে রাজি হননি।”আউটডোরে অন্য রোগী আসছেন না বলেই ধরা যায়।যারা আসছেন তারা বাধ্য হয়ে জটিল অবস্থায় পড়ে আসছেন”।
ঢাকাসহ এর বাইরের পরিস্থিতিও ভিন্ন নয়। উপজেলা শহরগুলোর অবস্থা আরো শোচনীয়।
সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর স্বাস্থ্য সেবার এই পরিস্থিতিতে এপ্রিল মাসের শুরুতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, কোন হাসপাতাল যদি ইমার্জেন্সিতে আসা রোগীকে চিকিৎসা না দেয়, তাহলে তাদের লাইসেন্স বাতিল করা হবে।
পরে এপ্রিলের নয় তারিখে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন বিএমএ-ভুক্ত ৬৯টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ২৪ ঘণ্টা সব রোগের চিকিৎসা সেবা দেবে হবে বলে সংবাদ ব্রিফিংয়ে জানান দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মোঃ এনামুর রহমান, যিনি বাংলাদেশে বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল সমিতিরও একজন নেতা।
তবে এসব ঘোষণার বাস্তবায়ন দেখা যায়নি।
এদিকে, রোগী ও চিকিৎসকদের মধ্যকার দ্বিমুখী অভিযোগের ব্যাপারটি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় স্বীকার করে নিয়েছে।
তবে, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে যাবার প্রেক্ষাপটে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর পরিকল্পনা করছে, সরকারি বেসরকারি সব হাসপাতালের সামর্থ্যকে একসঙ্গে মিলিয়ে করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের সেবা দেয়া হবে।
সেক্ষেত্রে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ সাধারণ অসুস্থতার জন্য মানুষকে সরকারি হাসপাতালে যাবার পরামর্শ দেন।
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের ফলে এখন বিশ্বজুড়ে যখন প্রতিদিনই পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে, তখন চিকিৎসক ও রোগী উভয়েই অপেক্ষা করছেন, কবে এই দুঃসময় শেষ হবে। আর সাধারণ মানুষের মধ্যে কিছুতেই যাতে অসুস্থ না হতে হয় এমন একটি চেষ্টা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।