করনায় গৃহবন্দি মানুষঃ প্রাণ চাঞ্চল্য প্রকৃতিতে!

তাইফুর সরোয়ারঃ

করোনার কারণে কার্যত বিশ্বের একটা বিরাট অংশ এখন গৃহবন্দী। মানুষ যখন তার লণ্ডভণ্ড জীবনকে বাঁচিয়ে নিতে ব্যস্ত, তখন প্রকৃতিকে অগোছালো করার কিংবা দূষণ করার সময় আর তার নেই। আর সেই সুবাদে দৃষ্টিগোচর হচ্ছে প্রকৃতির অভূতপূর্ব পরিবর্তন। বিভিন্ন অনলাইন মিডিয়া এবং সোসাল মিডিয়া গুলোতে ছড়িয়ে পড়া ছবিগুলি জানান দিচ্ছে যে মানুষের এই গৃহবন্দি হয়ে থাকার ফলে প্রাণ খুলে হাসছে প্রকৃতি। প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম মেনে নির্ভয়ে বিচরণ করছে ডলফিন, বানর, হনুমান, হরিণের মত লাজুক বন্যপ্রাণীরা।

বেশ কয়েক যুগ ধরে বিশ্বের মোটামুটি সব দেশই উন্নয়ন করার নামে এমন এক প্রতিযোগিতায় নেমেছে, যেখানে জীবনধারণের মান এর গুণগত দিক থেকে বিশ্লেষণ না করে বরং টাকার অঙ্ক দিয়ে বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। ফলশ্রুতিতে, উন্নয়ন করার তাগিদে নগরায়ন ও শিল্পায়নের নামে সবাই মেতে আছে পরিবেশ দূষণ করতে। এতে করে পৃথিবীর ওজোন স্তর ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে এবং দিনে দিনে দূষণের পরিমাণ পৃথিবীর ধারণ ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। তবে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের পর থেকে বিশ্বজুড়ে দেশগুলোর দূষণ কমে পরিবেশের ব্যাপক পরিবর্তন ঘটছে। বর্তমানে বিশ্বে গড়ে ৫ জন ব্যক্তির একজন লক ডাউনের কারণে ঘরে বন্দি। পরিবেশ দূষণকারী প্রজাতি অর্থাৎ মানুষেরা গৃহবন্দী থাকার সুবাদে ইতিবাচক পরিবর্তন আসছে বিশ্বজুড়ে।

চীনে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে কিছু অঞ্চলকে লক ডাউন করার কারণে সব ধরনের প্রতিষ্ঠান, কলকারখানা ও যানবাহন চলাচল বন্ধ করা হয়েছে, যা এখনো বেশ কিছু জায়গায় বহাল আছে। চীনের বাস্তুসংস্থান ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের মতে, এসব কারণে ফেব্রুয়ারি মাসের বিশুদ্ধ বায়ুর গড় দিন সংখ্যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ২১.৫% বেড়ে গেছে। নাসার গডার্ড স্পেস ফ্লাইট সেন্টারের গবেষক ফে লিউ জানান যে, তারা প্রথমবারের মতো গ্রিনহাউজ গ্যাস তথা বিষাক্ত গ্যাসের ক্ষেত্রে এত বড় পতন দেখেছে। সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি ক্লিন ওয়াটারের বিশ্লেষক লরি মিলিভারতার মতে, চীনে জানুয়ারির শেষ সপ্তাহ থেকে চার সপ্তাহের মধ্যে কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের পরিমাণ ২৫% হ্রাস পেয়েছে। আর পাওয়ার প্লান্টগুলোতে কয়লার ব্যবহার কমেছে ৩৬%। বিশ্বের পরিবেশ দূষণের শতকরা ৩০ ভাগের জন্য দায়ী এই চীন। তাই এই পতন বিশ্বজুড়েই এক অনন্য পরিবর্তন আনতে পারে এবং আমাদের পরিবেশের জন্য অবশ্যই তা ইতিবাচক।

চীনকে ছাড়িয়ে ইতালিতে করোনাভাইরাসের কারণে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা গিয়েছে। আক্রান্ত লক্ষ লক্ষ মামুষ আছে কোয়ারান্টাইনে।জরুরী প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকেই বের হওয়া অসম্ভব হয়ে গেছে মানুষের জন্য। এসব কারণে মিলান ও উত্তর ইতালির বেশ কিছু অংশে নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ ৪০% কমে গেছে। ভেনিস শহরের দূষিত পানি পরিষ্কার হতে শুরু করেছে৷

যুক্তরাজ্যে করোনাভাইরাস সতর্কতা হিসেবে জনগণের চলাচলের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। সময়োপযোগী নির্দেশনার কারণে পুরো যুক্তরাজ্যেই পরিবেশ দূষণ কমে গিয়েছে। উল্লেখ্য যে, যুক্তরাজ্যে ৮০% নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের কারণ যানবাহন চলাচল। লক ডাউনের জন্য একটি ডিজেল চালিত গাড়ি থেকে গড়ে ৫২ মিলিগ্রাম দূষণকারী পদার্থ বায়ুতে মিলিত যাওয়ার ক্ষেত্রে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

গত বছরের তুলনায় নিউ ইয়র্কে যানবাহনের চলাচল ৩৫% কমে গিয়েছে। যাতায়াত বন্ধ থাকায় কার্বন মনোক্সাইড নিঃসরণের পরিমাণ ৫০% কমে যায়। কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের ক্ষেত্রে ৫-১০% হ্রাস দেখা যায় এবং মিথেনের ক্ষেত্রেও হ্রাস দেখা যায়। দক্ষিণ কোরিয়াতেও বায়ু দূষণের হার কমে গিয়েছে।

পৃথিবীর সুন্দর সব জায়গায় পর্যটকের সমাগম নেই, তাদের ফেলে যাওয়া ময়লার স্তূপও নেই। অর্থাৎ কোনো প্রকার দূষণও নেই। পরিচ্ছন্ন পরিবেশ ও নির্মল বায়ুর উপস্থিতি সকল প্রাণীকেই আকৃষ্ট করে। সেই সুবাদে জাপান ও থাইল্যান্ডে বানর ও হরিণ দিব্বি ঘুরে বেড়াচ্ছে। একই ভাবে পৃথিবীর ব্যস্ত শহরগুলিতে ফাঁকা রাস্তা-ঘাটে দেখা মিলছে অনেক নাম না জানা পরিযায়ী পাখির।জনশূন্য ও দূষণ মুক্ত কক্সবাজারেও ভেসে উঠেছে দুর্লভ গোলাপী ডলফিন। সংক্রমণের ভয়ে কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকতে পর্যটকদের যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারির পাঁচ দিনের মাথায় প্রকৃতি তার নিজ রূপ ফিরে পায়। দেখা মিলে ১০-১২টি ডলফিনের। উপকূলীয় এলাকা মুখরিত বিভিন্ন দূর্লভ প্রজাতির পাখির কুহুতানে।

লক ডাউনে আমরা মানুষেরা ঘরে থাকার পর থেকে বিভিন্ন দেশেই এরকম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও পশুপাখিদের দেখা মিলছে। মানুষের কর্মকাণ্ডে যে তারাও অতিষ্ঠ- তা স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে।

আঁধার কেটে আলো আসবে এক সময়। করনার অভিশাপ থেকেও মুক্তি মিলবে মানবজাতির, ইনশাআল্লাহ। কিন্তু এই মহামারি আমাদের প্রকৃতির প্রতি সদয় হওয়ার যে শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছে তা উপলদ্ধি করে বিশ্ব পরিচালিত হলে আমাদের এই পৃথিবী হবে সকল প্রাণীকূলের নিরাপদ আবাসস্থল।

তথ্য সূত্রঃ বি বি সি নিউজ, সি এন এন, আনন্দবাজার পত্রিকা এবং ইন্টারনেট।

SHARE