।। তাইফুর সরোয়ার।।
গত বছরের ঘটনা। মাঘ মাসের পূর্ণ শীত তখন। মধ্য রাতে আমার কাছে এস.পি স্যারের ফোন আসল। নীলরাঙ্গা গ্রামের চেয়ারম্যানের বউ চেয়ারম্যানকে কুপিয়ে হত্যা করে গ্রামে গাঁ ঢাকা দিয়ে আছে। এস.পি. স্যার কেসটা আমাকে দেখার আদেশ দিলেন।
সময়টা ছিল আমার প্রমোশনের। সাব ইন্সপেক্টর থেকে ইন্সপেক্টরে প্রমোশনের সময়। ঐ সময়ে এস.পির মন যুগিয়ে চলা ছিল আমার একান্ত দায়িত্ব। তাই এই হাঁড় কাপা শীতে আমি তিনজন কনস্টেবলকে সাথে করে গাড়ি নিয়ে ছুটলাম নীলরাঙ্গা গ্রামের দিকে।
পুলিশ স্টেশন থেকে নীলরাঙ্গা গ্রামের দুরত্ব প্রায় পাঁচ কিলোমিটার। কুয়াশা ঢাকা গ্রামের মেঠো রাস্তায় গাড়ি চলছিল একটু সাবধানে। আমরা চেয়ারম্যানের বাড়ীতে যখন পৌছলাম তখন ফজরের আজান হচ্ছিল। চেয়ারম্যানের মর দেহটা তার শোবার ঘরেই ছিল। সে যেখানে খুন হয়েছিল সে ভাবেই তার দেহ পরে আছে। তার ঘরে কয়েকটি হুইস্কি এবং বিদেশী স্যাম্পানের বোতল দেখলাম। চেয়ারম্যান যে মদ্যপ ছিল এগুলোই তার প্রমাণ বহন করে। বাড়ীতে তেমন কোন মানুষজন দেখলাম না । শুধু এক বৃদ্ধ কে দেখলাম, বাড়ীর দোড় গোড়ায় দাড়িয়ে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। হবে হয়ত চেয়ারম্যানের খুব বিশ্বত এবং পুরানো চাকর। আমরা চেয়ারম্যানের লাসটা পোস্ট মর্টামের জন্য মর্গে পাঠাবার ব্যবস্থা করলাম। এরপর গ্রামের চৌকিদারকে সাথে নিয়ে চেয়ারম্যানের খুনি বউকে খোঁজা শুরু করলাম।
বিশাল বড় বাগান বাড়ি। বাড়ির পিছনটা সুপারি,
নারকেল, খেঁজুর, তাল গাছে ভরা। বাগানের ভিতরে
বিশাল বড় দিঘী। দিঘীর চারপাশে কয়েকটি কুঁড়ে ঘর। আমরা তারই একটিতে খোঁজা শুরু করলাম। সকালের সূর্য তখনও উঠেনি। সারা গ্রামকে ঘন কুয়াশা তার সাদা ওড়না দিয়ে ঢেকে রেখেছে। বাড়ির কর্তা এবং কর্তী তখনও গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। আমরা অনেক্ষণ দরজার কড়া নাড়ার পর বাড়ির কর্তা ঘুম চোখে দরজা খুলল। আকস্মাৎ পুলিশ দেখে তিনি যেন ভয়ে কাঠ হয়ে গেলেন। আমরা তাঁকে অভয় দিয়ে চেয়ারম্যানের খুনি বউয়ের সন্ধান চাইলাম। লোকটি জানাল তার ঘরে ঐ মহিলা নেই এবং তিনি তার সন্ধান জানেন না। জানলেও বলবেন না। অন্যান্য ঘর গুলোতে গিয়ে ও একই উত্তর শোনা গেলো। সকলেই ঐ মহিলার সন্ধান দিতে নারাজ। এদের এই অসম্মতি থেকে সহজেই অনুমান করা যায় যে, চেয়ারম্যান ভালো লোক ছিলেন না। জনগণ কে তিনি হয়ত অত্যাচার করতেন। তার বউ নিশ্চয়ই উদার হৃদয়ের ছিল। পাড়া পড়শীদের সাথে হয়ত তার সু-সর্ম্পক ছিল। তাই তার এ দুর্দিনে সবাই তাকে সাহায্য করছে।
অবশেষে আমরা ঢুকলাম এক বুড়ির ঘরে। বুড়ির ঘরে এক মহিলা শায়িত ছিল। চৌকিদার তার দিকে লক্ষ্য করে চেচিয়ে বলল, ঐ তো খুনি, চেয়ারম্যানের বউ।
আমি ঐ মহিলার দিকে ভাল করে তাকালাম এবং অবাক হলাম। বিস্ময়ে আমার চোখকেও বিশ্বাস করতে পারলাম না। এই মহিলা ছিল আমার পূর্ব পরিচিতা। এর নাম সোহাগী। বিস্ময়ে আমি অনুচ্চারিত রব তুললাম, সোহাগী!
সোহাগীদের বাড়িতে আমি লজিং থাকতাম। আমার অনার্স জীবনটা ওদের বাড়িতে থেকেই শেষ করি। আমি ওর ছোট ভাইকে সকাল সন্ধ্যা পড়া দেখিয়ে দিতাম। সোহাগী ছিল অসম্ভব সুন্দরী। দুধে আলতা ছিল গায়ের রং। চোখ দুটি ছিল হরিণীর মত। রহস্যে ঘেরা ছিল ওর হাসি। গ্রামের প্রায় ছেলেই ওর জন্য পাগল ছিল। সোহাগীর বাবা ছিল অনেক সম্পত্তির মালিক। সোহাগীর সৌন্দর্য এবং ওর বাবার সম্পত্তি হয়ত এদের ওর প্রতি দুর্বল হতে বাধ্য করেছিল।
ইন্সপেক্টার সাহেব থামলেন। আবার দম নিলেন। বললেন, সমীর সাহেব শীতে জমে গেছি। গলা বসে গেছে। শরীর গরম করা দরকার।
ইন্সপেক্টর সাহেবের গল্পটা আমার মনে অকৃত্রিম অগ্রহের সৃষ্টি করেছে। তার কাহিনীর প্রতিটি কথা আমি শুনছি খুব আগ্রহের সাথে। তার গল্পটা আমার মনে তীব্র উত্তোজনা সৃষ্টি করছে। তাই তাকে আবার তার কাহিনী রাজ্যে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য দ্রুত স্টেশনের দোকান থেকে দু’কাপ চা নিয়ে এলাম। ইন্সপেক্টর সাহেব চায়ের পেয়ালায় কয়েক বার চুমুক দিয়ে আবার বলতে লাগলেন, স্কুল জীবনের গন্ডি পেরিয়ে কলেজ জীবনে পা দেয়ার কয়েক মাস পর গ্রামের কিছু বখাটে ছেলেদের উত্যুক্তির কারণে সোহাগীর কলেজে যাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পরল। ওর বাবা বাড়ীতে রেখেই ওর পড়ালেখার ব্যবস্থা করলেন, যার দায়িত্বটা পরেছিল আমার উপর। সকাল সন্ধ্যা ও বই নিয়ে বসত আমার কাছে। মাঝে মাঝে আমি লক্ষ্য করতাম পড়ার দিকে মনোযোগ না দিয়ে এক মনে এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকত। অসাধারণ কিছু খোঁজার চেষ্টা করত। থেকে থেকে রহস্যময় হাসিতে হেসে উঠত। আমি ছিলাম ওর শিক্ষক এবং আমি যথার্থ শিক্ষকের মতোই আচরণ করতাম। পড়া রেখে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রসঙ্গে কথা বলতে চাইত ও। মাঝে মাঝে আমার সৌন্দর্য প্রশংসায় নিজেকে ব্যস্ত রাখত। কিন্তু আমি বিভিন্ন অজুহাতে অপ্রাসঙ্গিক কথা বাদ দিয়ে লেখাপড়ার প্রসঙ্গে ফিরে আসতাম। ক্রমান্বয়ে আমার প্রতি ওর ভালোবাসা এবং দুর্বলতা উপলদ্ধি করতে লাগলাম। আমারও যে ওর প্রতি ভালোলাগা ছিল না তা ঠিক নয়। হয়ত একটু বেশিই ভালোবাসতাম। তাই আমার অনিশ্চিত জীবনের সাথে ওর সুনিশ্চিত জীবনকে জড়াতে চাইনি বলেই আমার ভালোবাসা তার প্রতি পূর্ণরূপে নিবেদিত হয়নি। অনার্স পাশের পর আমি ওদের বাড়ী থেকে বিদায় নিয়ে চাকরির সন্ধানে ঢাকার ট্রেন ধরার জন্য স্টেশনে পৌছলাম। স্টেশনে পৌছে দেখলাম সোহাগী স্টেশনের পাশের বটগাছের আড়ালে মলিন মুখে দাড়িয়ে আছে। আমি ওর কাছে গেলাম। বিদায় এবং আশীর্বাদ চাইলাম। অনেকক্ষণ নিরব থাকার পর সোহাগী বলল, যেতে হলে আমকেও সাথে নিয়ে চলুন, আমিও যাব আপনার সাথে।আমি আমার বুকের গভীরে জমে থাকা দুঃখটাকে ঈষৎ হাসির মাধ্যমে প্রকাশ করে বললাম, পাগলামি করো না, বাড়ি ফিরে যাও। আমি আশীর্বাদ করছি তুমি সুখি হবে।
ট্রেন আসল। থামল! আমি ট্রেনে উঠলাম। ট্রেন আবার চলতে লাগল। সোহাগী আমার চলার পথে অশ্রসিক্ত চোখ জোড়া দিয়ে অপলক তাকিয়ে থাকল। আমিও ট্রেনের জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকলাম যতক্ষণ পর্যন্ত ওকে দেখা গেল। আমার হৃদয় মন্দিরে ওর জন্য যে ভালোবাসা সঞ্চিত ছিল তা সেদিন আরাধনার অভাবে পূর্ণরুপে বিকোশিত হতে পারেনি। সেই ভালোবাসার জোর এত ক্ষীণ ছিল তা সেদিন ওকে আমার সঙ্গে সঙ্গী করে নিতে সাহস জোগায়নি। সেদিনের পর ওর সঙ্গে আমার আর দেখা হয়নি। জীবন এবং জীবিকার তাগিদে এতটাই ব্যস্ত ছিলাম যে, সোহাগী কিংবা ওর পরিবারের কারো সঙ্গে আমার যোগাযোগ রাখা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। পরে অবশ্য জানতে পেরেছি যে ওর ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে হয়েছে। ওর স্বামীর অঢেল প্রতিপত্তি থাকলেও তার চরিত্রে কয়েকটা কালো দাগ ছিল।
চলবে…