মোঃ মিজানুর রহমান
ভোলা নিউজ-২২.০৪.১৮
সেকালে বাবা মানেই উপার্জনকারী, অন্ন যোগদানকারী সংসারের সব হর্তা কর্তা। তার বাসায় আগমনের সময় হলেই সবাই তটস্থ থাকত। কবরের শুনশান নীরবতা হতো বাসার পরিবেশ। যাতে বাবা এসে শান্তিতে পোষাক পালটে, শাওয়ার নিয়ে একটা নির্জন বিশ্রামাগার পান। মুরগির বড় ঠ্যাং, মাছের মাথা, পেটি সব ই থাকত এই অক্লান্ত পরিশ্রমী বাবার জন্য। তারপর উনি খেয়ে উঠার পর আমরা খেতে বসতাম। অবশিষ্ট যা আছে তা দিয়ে আস্তে আস্তে করে খেয়ে যেতাম। মা এর প্লেটে কি কিছু থাকত কি থাকত না খবর ও রাখতাম না। মা সবার অগোচরে সব কাজ গুছিয়ে খেয়ে নিতেন চুপিচাপি। তারপর বিছানায় যেতেন অনেক রাতে পরিশ্রান্ত হয়ে। বাবা শুধু দেখতেন রাত ১২ টা পর্যন্ত আমরা পড়ার টেবিলে কিনা, ক্লাশে মেরিট লিস্টে আছি কিনা। পরিবার নিয়ে বাবা সহ টিভি দেখা, কোথাও বেড়াতে যাওয়া, কোন রেস্তোরায় খাওয়া বা সবাই মিলে গল্প করাটা ছিল বেশির ভাগ পরিবারেই আকাশ কুসুম কল্পনার মত। আমাদের অসুখ হলে মা ই বসে কপালে জল ঢালতেন, গা মুছিয়ে দিতেন, ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতেন। টাকার যোগান বাবাই দিতেন। নতুন পোষাক সাধারনত ঈদ বা পূজায় পাওয়া যেত। অনেক সময় স্কুল ড্রেস ই দিত নতুন পোষাক হিসাবে। অন্যের বাসার ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানি এনে খাওয়া, অন্যের বাসায় গিয়ে টিভিতে টারজান দেখা, ল্যান্ড ফোন আসলে ডেকে দেয়া ইত্যাদি ছিল আমাদের প্রাত্যহিক জীবন। টানাটানি হয়ত ছিল বা ছিল না, অর্থের প্রাচুর্য না থাকলেও শান্তির একটা স্বাদ ছিল সবার মনে। অল্পতেই তৃপ্ত ছিলাম। ছিল না প্রযুক্তিগত সুবিধা। Ipad ছিল না, ছিল ফুটবল, ছিল সাতচারা। হেলো ছিল না, ছিল কেমন আছিস দোস্ত। এসি ছিল না, কিন্তু দু:স্বপ্ন ছাড়া ঘুম ছিল। সিডান ছিল না কিন্তু বাসে দল বেধে ঝুলে যাওয়ার মজা ছিল। চিকেন সসেজ ছিল না, ছিল ডাল পুরি। একটা আম ভাই বোন মিলে কেটে খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলতাম। বাবা মা বা গুরুজন দের বিধাতার আসনে বসাতাম। একান্নবর্তী পরিবার কাঠামো আমাদের আদর, স্নেহ, মমতা, সন্মান, সহমর্মিতা শিখিয়েছে। প্রতিবেশিদের সাথে ছিল আত্মিক সম্পর্ক। বাসায় ভাল কিছু রাধলে পাশের বাসার খালার বাসায় চলে যেত এক বাটি। গ্রাম থেকে কেউ বেড়াতে আসলে ঈদ ঈদ লাগত। মাগরেবের আযানের সাথে সাথে দৌড়ে ঘরে এসে পড়ার টেবিল। গল্পের বই এর তালিকায় মাসুদ রানা, তিন গোয়েন্দা, দস্যু বনহুর, ওয়েস্টার্ন, রুদ্র, শামসু রাহমান, শরৎচন্দ্র, সমরেশ, বুদ্ধদেব, বিমল মিত্র। বছরে দু একবার নানা বাড়ি বা দাদি বাড়ি বেড়াতে গিয়ে আর ফিরে আসতে না চাওয়া। এই তো ছিল সেদিনের গল্প।
আর একালে?? প্রযুক্তি, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, উন্নয়নের স্রোত দিয়েছে নানা সুখ। দিতে পারে নি শান্তি। পরিবার সহ দেশ বিদেশে বেড়াতে যাওয়া, প্রায় ই হুট হাট করে রেস্তোরায় খাওয়া, এই পার্টি সেই পার্টি, ঘর থেকে বের হলেই গাড়ি, যখন ইচ্ছা তখন নতুন কাপড়, আর সব কিছুইতেই সেল্ফি, ফেবু, ইন্সটাগ্রাম। বাবা মা নিজেদের প্লেটের ভাল কিছু বাচ্চাদের জন্য দেয়া, ভাল স্কুল, ভাল টিউশন। হাবি, হানি, ওয়াও, জোস, বাজ, ফ্রান্স, ডুড, ইয়াম্মি যুগের উত্তাল হাওয়ায় বেসামাল আমরা। আমাদের সাথে পাল্লা দিয়ে বাচ্চারা ও রাত বিরাতের নানা পার্টি ফাংশন নিয়ে ব্যস্ত। চার জন চার দিকে Ipad এ নানা আড্ডায় ব্যস্ত। লাভ ইউ উচ্চারিত হচ্ছে অনেক বেশি, কথায় কথায় হাগ ও করছি আবেগের ঝলক দেখানোর জন্য, মিস ইউ খুব কমন শব্দ। শুধু জানি না পাশের ফ্লাটে কে থাকে। জানি না আমার ছেলে কি আলু পুরি খায় না ইয়াবা খায়, জানি না আমার দাদার বাড়ি কোথায়, গ্রামের কেউ আসলে মাকে জিজ্ঞেস করি “Mom, who is that villager?”। রাতে পড়ার টেবিলে না থেকে চলে মেসেঞ্জার আর হোয়াটস এপ, শরৎচন্দ্র আর শামসুর রাহমান নেই আমাদের, আছে নানা গেইমস আর হিন্দি মাস্তি ফিল্ম। পরিবার আর আত্মার খুটি গুলোতে লেগেছে উই পোকা। ইংরেজি স্কুলে পড়িয়ে তৃপ্তির হাই তুলছি। চিন্তা নেই সেদিন বেশি দূরে নেই সংসারের আবজর্না মনে করে আমাকে আপনাকে দেশে ফেলে সন্তানরা থাকবে প্রবাসে, মারা যাওয়ার পর অবশ্য সন্তান দের জন্য বারডেমের হিমাগারে থাকব আমরা, আমাদের সন্তান রা শেষ দেখা না দেখে ছাড়বে না আমাদের। আবার আমাদের যাতে একা থাকতে না হয় সেইজন্য আমাদের কেউ কেউ আবার বৃদ্ধাশ্রমেও থাকব। ডে কেয়ার, কেটারিং, উবারের মত বৃদ্ধাশ্রম ও ভবিষ্যৎ এর ভাল ব্যবসা।
আমার বাবা মা যেমন তাদের সব দিয়ে আমাদের ভাল রেখেছেন, তেমনি আমরা ও আমাদের সব দিয়ে ভাল রাখব আমাদের সন্তানদের। এটাই একাল সেকালের বড় মিল।
ভাল থাকুক সবাই, ভাল থাকুক প্রিয়/ অপ্রিয় সবাই।
লেখক পরিচিতিঃ
মোঃ মিজানুর রহমান
- ডিডি, বাংলাদেশ পাসপোর্ট