আতঙ্কে মিন্নির পরিবার

বিশেষ প্রতিনিধিঃ-
রিফাত শরীফ হত্যায় জড়িতদের দ্রুত গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে ফুঁসে উঠেছে বরগুনাবাসী। গতকাল সকাল ১০টায় বরগুনা প্রেস ক্লাব প্রাঙ্গণে ‘বরগুনার সর্বস্তরের জনগণ’-এর ব্যানারে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করা হয়। এতে বক্তব্য দিয়েছেন নিহত রিফাতের পিতা আবদুল হালিম। এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জড়িত সন্দেহে ঘাতক নয়নের দুই বন্ধু সাইমুম ও রকিবুলকে আটক করেছে পুলিশ। ওদিকে মানববন্ধন শেষে বরগুনা জেলা শহরে বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়। মিছিলটি শহরের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে। মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিলে নানা শ্রেণি-পেশার তিন সহস্রাধিক মানুষ অংশগ্রহণ করে। মানববন্ধনে বক্তব্য দেয়ার সময় কান্নাজড়িত কণ্ঠে রিফাতের বাবা আবদুল হালিম বলেন, রিফাত আমার একমাত্র সন্তান।

রিফাতের মা শয্যাশায়ী, ১৮ বছর ধরে তিনি অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে আছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার আকুল আবেদন, আমার ছেলে হত্যাকারীদের অবিলম্বে আইনের আওতায় এনে বিচার করা হোক।

রিফাতের বাবা আরো বলেন, বাবা মারা গেলে ছেলে এতিম হয়, আমি এতিম হয়ে গেছি। আমার একমাত্র ছেলেকে কীভাবে নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে তা পুরো বিশ্ববাসী দেখেছে। আমার ছেলে সকালে তার মায়ের কাছ থেকে পাঁচশ টাকা নিয়ে বেরিয়ে লাশ হয়ে বাড়িতে ফিরেছে। কিন্তু আমার ছেলের হত্যাকারীদের পুলিশ এখনো গ্রেপ্তার করতে পারেনি। আমি আমার ছেলের হত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশে জেলা যুবলীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট কামরুল আহসান মহারাজ, জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রইসুল আলম রিপন, সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান, জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক সাহাবুদ্দীন সাবু, জেলা আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট সুনাম দেবনাথ, জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট জুবায়ের আদনান অনিক প্রমুখ বক্তব্য দেন। মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিলে নানা শ্রেণি-পেশার কয়েক সহস্রাধিক মানুষ অংশ নেয়।

আতঙ্কে রিফাতের স্ত্রী মিন্নির পরিবার: মাত্র দুই মাস আগে বিয়ে হয়েছিল তাদের। নতুন জীবন শুরু করার উচ্ছ্বাস ছিল তাদের চোখে-মুখে। মাত্র তিনদিন আগেও স্বামী শাহনেয়াজ রিফাত শরীফের সঙ্গে আনন্দঘন সময় কাটছিল আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নির। হঠাৎ মো. সাব্বির আহমেদ নয়ন ওরফে নয়ন বন্ড নামক ভয়াল ঘাতকের আঘাতে মুহূর্তেই সব স্বপ্ন ভেঙে তছনছ হয়ে যায় মিন্নির। চোখের সামনে স্বামীকে কোপানোর নৃশংস দৃশ্য দেখে এখনো আতঙ্কিত মিন্নি। এদিকে রিফাত হত্যার তিন দিন পর নতুন আতঙ্ক বাসা বেঁধেছে মিন্নি ও তার পরিবারের সদস্যদের মধ্যে। এবারের আতঙ্ক সন্ত্রাসী নয়ন বন্ড না হলেও তার সঙ্গী ও সহযোগীরা।

মিন্নির পরিবারের লোকজন জানায়, হত্যাকাণ্ডের দিন থেকে অচেনা একদল লোকের আনাগোনা চলছে মিন্নিদের বাড়ির আশেপাশে। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় অজ্ঞাত একদল লোক মোটরসাইকেলে মিন্নিদের বাড়ির সামনের রাস্তায় আসে। তারা স্থানীয়দের কাছ থেকে মিন্নি ও তার পরিবারের বিষয়ে নানা কথা জিজ্ঞাসা করে। পরে বাড়ির সামনে পুলিশ দেখে দ্রুত চলে যায় তারা।
মিন্নির পরিবারের অভিযোগ, অচেনা এসব লোকের মধ্যে স্বয়ং নয়ন বন্ড না থাকলেও তারা তার সঙ্গী ও সহযোগী হতে পারে। তারা নয়নের নির্দেশে এখনো মিন্নি ও তার পরিবারের লোকজনের ক্ষতি করার চেষ্টা করছে। গতকাল শনিবার মিন্নির বাবা মোজ্জামেল হোসেন কিশোর ও মা জিনাত জাহান মুন্নীর সঙ্গে কথা বলে এসব কথা জানা যায়।

এ বিষয়ে মিন্নির বাবা মোজাম্মেল হোসেন বলেন, আমাদের আতঙ্ক আরো বেড়ে গেছে। প্রতিনিয়ত নয়নের লোকজন রাতের বেলায় আমাদের বাড়ির সামনে মোটরসাইকেল নিয়ে ঘোরাফেরা করছে। তারা সুযোগ পেলেই মিন্নি অথবা আমাদের ক্ষতি করবে।
বৃহস্পতিবার রাতের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার রাতে বাড়ির সামনের রাস্তায় কিছু লোকজন এসেছিল। আমাদের বাড়ির এক মুরব্বিকে তারা জিজ্ঞাসা করে ‘রিফাতের বউ মিন্নির বাড়ি কোথায়’? তিনি বয়স্ক হওয়ায় এত কিছু না বুঝে তাদের বাড়ির রাস্তা দেখিয়ে দেন।

পরে তারা যখন বাড়ির দিকে আসতে শুরু করে তখন দেখে সামনে লোকজন। তখন তারা আবার মুরব্বিকে জিজ্ঞাসা করে ‘বাড়ির সামনে এরা কারা।’ তখন মুরব্বি বলেন, পুলিশ। এই কথা শুনে তারা দ্রুত পালিয়ে যায়।
তিনি বলেন, নয়ন ও তার লোকজনের ভয়ে আমরা এখন জিম্মি হয়ে আছি। বাড়ি থেকে বের হতে পারছি না। কখন যে কী হয়ে যায়, সেই ভয়েই থাকি। ছেলেমেয়েদের আর স্কুল- কলেজে পাঠাতে পারবো কি-না, তাও জানি না। কারণ নয়ন অনেক বড় ভয়ানক সন্ত্রাসী। তার লোকজন এখনো চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।
তবে মিন্নি ও তার পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সতর্ক রয়েছে জেলা পুলিশ। মিন্নিদের বাড়ির সামনে পুলিশের একজন উপ-পরিদর্শকের নেতৃত্বে পাঁচজন পুলিশ সদস্য পাহারা দিচ্ছেন।

পাহারারত পুলিশের উপ-পরিদর্শক মো. ইদ্রিস বলেন, মিন্নি ও তার পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিতে আমরা সব ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। আমরা পরবর্তী নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত মিন্নিদের বাড়ির সামনে পাহারায় থাকবো।
এদিকে বরগুনায় স্ত্রীর সামনে শাহনেওয়াজ রিফাত শরীফকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় জড়িত সন্দেহে সাইমুম ও রকিবুল নামে দুই যুবককে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। শুক্রবার রাতে পটুয়াখালী শহরের গালর্স স্কুল এলাকা থেকে সাইমুমকে গ্রেপ্তার করা হয়। সাইমুমকে বর্তমানে পটুয়াখালী সদর থানার হাজতে রাখা হয়েছে। আটক সাইমুম বরগুনা শহরের স্টেডিয়াম এলাকার কাউছার হোসেনের ছেলে। সে নয়ন বন্ড বাহিনীর সঙ্গে চলাফেরা করে বলে স্বীকার করেছে। আর র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার রকিবুল ইসলাম রিফাত এ হত্যা মামলার ১০ নম্বর আসামি। রিফাতকে বরগুনার সোনালী পাড়া থেকে আটক করেছে র?্যাব-৮ এর সদস্যরা।

SHARE