বিশেষ প্রতিনিধিঃ
কে নেন নি এই মুকুটহীন সম্রাটের টাকার ভাগ। রাস্তার ফকির থেকে শুরু করে সংসদ সদস্য কেউ বাদ যাননি এই অপরাদ দুনিয়ার ভাগ বাটোয়ারা থেকে। র্যাব এর দৃষ্টিও এখন তাদের দিকে। রাজধানির অপরাধ সাম্রাজ্যের মুকুটহীন বাদশা ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটের অবৈধ টাকার উৎস এবং এই টাকার ভাগ কারা নিয়েছেন তা তদন্ত করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তার অবৈধ আয়ে যারা ভাগ বসিয়েছেন, মাসোহারা নিয়েছেন তারা আছেন এখন আতঙ্কে। আতংকে থাকা উজির নাজিরের মধ্যে কয়েকজন সংসদ সদস্যও রয়েছেন।
ইতোমধ্যে তার আস্তানা থেকে একটি নথির সন্ধান পেয়েছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। ওই নথিতে অনেক রাঘব-বোয়ালের নাম রয়েছে। প্রতিমাসে কাকে কত টাকা দিতেন সেই হিসাবও আছে নথিতে। সম্রাটের অন্যতম সহযোগী খালেদ মাহমুদ ভুইয়াও ওইসব রাঘববোয়ালদের নিয়মিত অর্থ দিয়ে আসছিলেন। প্রতি রাতেই কোটি কোটি টাকা জমা হতো সম্রাটের দরবারে। সন্ধ্যা হলেই কাকরাইলের ভূঁইয়া ম্যানশনের চতুর্থ তলায় হাজির হতেন তার অপরাধ সম্রাজ্যের হোতারা।
বস্তায় ভরে নিয়ে যেতেন টাকা। প্রতিদিনই এসব টাকা ভাগ বাটোয়ারা হতো। ক্যাসিনো, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, মাদক বাণিজ্য, কোরবানির পশুর হাট, সিটি করপোরেশন মাকের্টে অবৈধ দোকান এরকম বিভিন্ন উৎস থেকেই কমিশন পেতেন অপরাধ সাম্রাজ্যের মুকুটহীন এই সম্রাট। টাকা পেতেন আবার একটি পক্ষকে টাকা দিতেনও তিনি।
টাকা নিতে অনেকেই ধর্না দিতেন সম্রাটের দরবারে। তাদের মধ্যে বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তি রয়েছেন। তবে কোনো কোনো ব্যক্তিকে মোটা অঙ্কের টাকা পাঠানো হতো প্রতি মাসের শেষের দিকে। টাকা পাঠাতে দেরি হলে তারা নিজেরাই যোগাযোগ করতেন। প্রথম সারির কয়েক নেতা, সরকারি কর্মকর্তা থেকে শুরু করে টাকা পাঠানো হতো বিভিন্ন সেক্টরে। এমনকি দেশের বাইরে অবস্থান করা নেতা ও সন্ত্রাসীদেরও টাকা পাঠাতেন ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট। ক্যাসিনো ও চাঁদাবাজির টাকা সঙ্গী, অনুসারীদের মধ্যেই বিলিয়ে দিতেন তিনি। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য। গ্রেপ্তারের পর গতকাল রমনা থানায় তার বিরুদ্ধে অস্ত্র ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে দুটি মামলা করেছে র্যাব।
তার আগে রোববার ভোরে কুমিল্লা থেকে গ্রেপ্তারের পর র্যাবের কাছে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন যুবলীগের এই নেতা। গ্রেপ্তারের পর থেকেই একপর্যায়ে অনুশোচনায় ভোগেন তিনি। কান্নাও করেছেন একাধিকবার। নিজের অপরাধের জন্য তার সঙ্গীদের দায়ী করেছেন। এমনকি দলের অনেক সিনিয়র নেতাদেরও দায়ী করেছেন সম্রাট। সম্রাট দাবি করেছেন, তার হাত থেকে টাকার ভাগ নিয়েছেন অনেকেই। এমনকি দলীয় সভা-সমাবেশে বিপুল টাকা ব্যয় করতেন তিনি। তিনি জানিয়েছেন, ‘পোলাপান’ সংগ্রহ করতে টাকা লাগে। তাদের হাত খরচ দিতে হয়। তাদের পরিবারের প্রয়োজনেও টাকা দিতে হয়। এসব ক্ষেত্রে টাকা দিতেন তিনি। আবার কর্মীদের মধ্য থেকেই অনেকে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা নিয়ে হাজির হতো তার কাছে। অবৈধ নানা ব্যবসা, দোকান, ফুটপাত দখল থেকে টাকা আসতো। বড় অঙ্কের টাকা আসতো ক্যাসিনো ও মাদক থেকে। সম্রাটের অনুসারীদের অনেকেই সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর, এমনকি তার এই সিন্ডিকেটে সংসদ সদস্যও রয়েছেন।
তার এই অবৈধ টাকার লেনদেনের হিসাব রাখতেন যুবলীগের দক্ষিণের এক নেতা। তবে টাকা লেনদেনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতেন যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। কয়েক মাস আগে থেকে টাকার লেনদেন নিয়েই সম্রাটের সঙ্গে দুরত্ব সৃষ্টি হয় খালেদের। সম্রাটের অবৈধ আয়ের একটা বিরাট উৎস নিয়ন্ত্রণ করতেন ঢাকা দক্ষিণের নয় নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হাজী এ কে এম মমিনুল হক সাঈদসহ আরো কয়েকজন কমিশনার। সূত্রমতে, সম্রাট স্বীকার করেছেন তার রয়েছে বিশাল ক্যাডার বাহিনী। মূলত তার ‘পোলাপানরা’ই বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে নিয়মিত চাঁদা সংগ্রহ করে। অনেকক্ষেত্রেই দলের সভা-সমাবেশের অজুহাতে সংগ্রহ করা হতো। এছাড়া মতিঝিল, পল্টন, কমলাপুর, ফকিরাপুল, কাকরাইল এলাকায় কেউ ভবন নির্মাণ করতে গেলেই সম্রাটকে দিতো হতো মোটা অঙ্কের টাকা। ঢাকার বিভিন্নস্থানে ভবন, ফ্ল্যাট দখল করছে তার বাহিনী।
সম্রাটের অনুসারীদের নামে অভিযোগ করার সাহস পেতো না কেউ। র্যাবের কাছে সম্রাট জানিয়েছেন, তাকে অনেকেই ভয় পেতো। তিনি কখনও ভাবতে পারেননি তাকে এভাবে গ্রেপ্তার করা হবে। ঝামেলা এড়াতে নিজের দলের প্রভাবশালী নেতা থেকে শুরু করে উচ্চ পদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়মিত চাঁদা দিতেন তিনি। সরকার পরিবর্তন হলে দেশ ছাড়ার পরিকল্পনা ছিলো তার। বিদেশে কয়েক নেতাকে বড় অঙ্কের টাকা পাঠাতেন সম্রাট। সূত্রেমতে, মমিনুল হক সাঈদ ও এনামুল হক আরমানকে নিয়ে প্রায়ই সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া যেতেন তিনি। সিঙ্গাপুরে ক্যাসিনোতে খেলতেন সম্রাট। তবে তিনি কোথায় টাকা রাখতেন এ বিষয়ে বিস্তারীত তথ্য পায়নি র্যাব। ধারণা করা হচ্ছে, অস্ট্রেলিয়াতে টাকা পাঠাতেন সম্রাট।
?অন্তত ১০টি ক্যাসিনোর পুরো নিয়ন্ত্রণ ছিলো সম্রাটের হাতেই। ক্যাশিয়ার হিসেবে একেক ক্লাব থেকে একেকজন টাকা তুলতো। মতিঝিল ক্লাব পাড়া থেকে প্রতিদিন উঠতো ৩০-৩৫ লাখ টাকা। ক্যাশিয়ার ছিল ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ও নয় নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মমিনুল হক সাঈদ। অন্যান্য ক্যাসিনোর ক্যাশিয়ার ছিলো, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের বহিস্কৃত সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ ভূঁইয়া, বহিস্কৃত সহ-সভাপতি আরমানসহ আরো কয়েকজন।
পল্টনের জামান প্রীতম টাওয়ার থেকে প্রতিদিন আয় হতো ১০ লাখ টাকা। মতিঝিলে বিআইডব্লিউটিএ ভবন নিয়ন্ত্রণ করত খালেদ ভূঁইয়া। ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলমের সঙ্গে রয়েছে সম্রাটের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। ওই কমিটিতে বেশ প্রভাব ছিলো সম্রাটের। মহানগর দক্ষিণ ছাত্রলীগের বর্তমান এক শীর্ষ নেতা এবং আগের কমিটির এক শীর্ষ নেতা মাদক সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত।
অপরাধ সাম্রাজ্যের এই মুকুটহীন সম্রাট ও তার সহযোগী যুবলীগ নেতা আরমানকে রোববার ভোরে কুমিল্লা থেকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। গ্রেপ্তারের পর সম্রাটকে নিয়ে কাকরাইলে তার অফিসে অভিযান চালানো হয়। এসময় ক্যাঙ্গারুর চামড়া সংরক্ষণের দায়ের তাকে ছয় মাসের কারাদন্ড দেয় র্যাবের ভ্রাম্যমান আদালত। একইভাবে গ্রেপ্তারের সময় মাদকসেবনরত অবস্থায় থাকা আরমানকেও ছয় মাসের কারাদন্ড দেয়া হয়। ওই দিনই তাদের জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। এ বিষয়ে গতকাল রমনা থানায় অস্ত্র ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে পৃথক দুটি মামলা করা হয়েছে।
সকল অজানা রহস্য নিয়ে র্যাব সদর দপ্তরের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক লে. কর্নেল সারওয়ার বিন কাশেম বলেন, র্যাবের দায়েরকৃত ২ মামলায় সম্রাটের রিমান্ড চাওয়া হবে। সম্রাটের অবৈধ অর্থের উৎস, ক্যাসিনোর টাকা কোথায় যেতো, দেশের বাইরের অর্থপাচার হতো কি-না তা খোঁজা হবে। বিদেশে অর্থপাচারের ব্যাপারে কিছু তথ্য-উপাত্ত ইতোমধ্যে র্যাব এর হাতে এসে পৌঁছেছে। সকল তথ্য উপাত্য গভীর ভাবে তদন্ত সাপেক্ষে পপর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।