মোঃ আরিয়ান আরিফ।।
আজ ২৯ এপ্রিল, উপকূলবাসীর কাছে এক দুঃসহ স্মৃতির নাম। ১৯৯১ সালের এ দিন রাতে বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগর উপকূলে আঘাত হেনেছিল ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস। লাশের পর লাশ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল চারদিকে।বিস্তীর্ণ অঞ্চল পরিণত হয় ধ্বংসস্তূপে।
২৯ বছর আগের সেই মহাপ্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের আঘাত তছনছ করে দিয়েছিল উপকূলীয় জনপদ। ঘণ্টায় ২০০ থেকে ২২৫ কিলোমিটার গতিবেগের প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড় এবং ২০ থেকে ৩০ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাসে দেশের উপকূলীয় এলাকা পরিণত হয়েছিল বিরানভূমিতে।
ভেসে গিয়েছিল ফসলের ক্ষেত, লাখ লাখ গবাদিপশু। ভয়াবহ ওই ঘূর্ণিঝড়ে মারা যান প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার মানুষ। যদিও সরকারি হিসাব মতে মৃতের সংখ্যা ১ লাখ ৩৮ হাজার।
ক্ষতিগ্রস্তদের মতে, সেদিন আবহাওয়া বিভাগ উপকূলীয় এলাকায় ৯নং সতর্ক সংকেত জারি করলেও অজ্ঞতার বশে লোকজন নিরাপদ স্থানে না যাওয়ায় মহা দুর্যোগের শিকার হন। রাত ১০টার পর ১০ থেকে ২০ ফুট উচ্চতায় সাগরের পানি মুহূর্তেই লোকালয়ে ঢুকে জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবলীলায় অনেক মা হারায় সন্তান, স্বামী হারায় স্ত্রী, ভাই হারায় বোনকে। অনেক পরিবার আছে যাদের গোটা পরিবারই পানির স্রোতে হারিয়ে গেছে। ২৯ এপ্রিলের সে ভয়াল স্মৃতি মনে করে এখনও কাঁদেন স্বজন হারানো উপকূলবাসী।
প্রশাসনের হিসাব মতে, ২৯ এপ্রিলের ঘূর্ণিঝড়ে উপকূলীয় ১৯ জেলার ১০২ থানা ও ৯টি পৌরসভায় ১ লাখ ৩৮ হাজার ৮৮২ জন নিহত, ১২ হাজার ১২৫ জন নিখোঁজ, ১ লাখ ৩৯ হাজার ৫৪ জন আহত হন। মাছ ধরার ট্রলার, নৌকা, বৈদ্যুতিক খুঁটি, গাছ-পালা, চিংড়ি ঘের, স্কুল-মাদরাসা, পানের বরজ, লাখ লাখ গবাদি পশু, ব্রিজ কালভার্ট ভেঙ্গে গিয়ে ক্ষতি সাধিত হয় কয়েক হাজার কোটি টাকার। তাই ২৯ বছর পরও অতীতের স্মৃতি মুছতে পারেনি উপকূলবাসী।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, ১৫৬১ সালের জলোচ্ছ্বাসেও উপকূলের বিপুল মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। এছাড়া ১৭৬২ সালে, ১৭৯৫ সালের ৩ জুন, ১৮৯৭ সালের ২৪ অক্টোবরে, ১৯০৫ সালের ২৯ এপ্রিলে, ১৯৬৩ সালের ২৭ মে, ১৯৭২ সালের অক্টোবরে, ১৯৯৭ সালের নভেম্বরে, ১৯৬৫ সালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে কুতুবদিয়া-দ্বীপসহ উপকুলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। সর্বশেষ ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাসে কুতুবদিয়া খুদিয়ার টেক নামক একটি এলাকা পুরো বিলীন হয়ে গেছে।
১৯৯১ সালের এ দিনে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি ঘটে কক্সবাজারের দ্বীপ উপজেলা মহেশখালীর উপ-দ্বীপ ধলঘাটা-মাতারবাড়ি, পেকুয়ার মগনামা ইউনিয়ন, কুতুবদিয়ার প্রায় পুরো উপজেলা এবং সদরের বৃহত্তর গোমাতলী এলাকায়। ওখানে অধিকাংশ বাড়ি থেকে পরিবারের ৫-৬ জন লোক মারা যান। অনেক যৌথ পরিবারে ৪০ জন মারা যায়। তাই এ দিনটিতে এখনও স্বজন হারানোর বেদনায় বিলাপ করেন অনেকে।
এতকিছুর পরও কক্সবাজারের উপকূলে পর্যাপ্ত ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নেই। বিদ্ধমান ৫ শতাধিক আশ্রয় কেন্দ্রের অধিকাংশ ব্যবহার অনুপযোগী। শুধু সাইক্লোন সেল্টার নয়, উপকূলের কয়েকশ’ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ এখনো চরম ঝুঁকিতে রয়েছে। ২৯ এপ্রিলের ঘূর্ণিঝড়ে এসব উপকূলীয় বেড়িবাঁধ বিলীন হয়েছিল। ওই ভাঙা বাঁধ এখনো পরিপূর্ণ মেরামত হয়নি।
এদিকে, সারা দেশের মতো কক্সবাজারেও করোনার প্রাদুর্ভাবে লকডাউন পরিস্থিতি থাকায় অন্য সময়ের মতো শোক র্যালি বা ঘটা করে মিলাদ ও মোনাজাত না হলেও নিহত এবং নিখোঁজদের আত্মার মাগফেরাত কামনায় স্বজনরা নিজেদের মতো করে দোয়া করবেন।