আজ পহেলা বৈশাখ

মোঃ আশরাফুল আলমঃ
পুরাতন বছরের আবর্জনা ধুয়ে, দুঃখ-হতাশা-গ্লানিময় অতীতকে ভুলে এক সহজাত প্রয়াসের মধ্য দিয়ে এসেছে নুতন বছর । আজ মঙ্গলবার পহেলা বৈশাখ ১৪২৭ বঙ্গাব্দ। নতুন আশা ও স্বপ্ন নিয়ে এক সুন্দর আগামীর পথে পদাংকনের সূচনা হলো। গতকাল সোমবার পশ্চিম-দিগন্তে আবির ছড়িয়ে ১৪২৬ বঙ্গাব্দের শেষ সূর্য অস্তমিত হয়েছে। আজকের সকালের সূর্যের আভা চোখে পরার সাথে সাথেই সারাদেশ বৈশাখী উৎসবে মুখর পরিবেশে পান্তা-ইলিশ নিয়ে মাতামাতি করার কথা থাকলেও করোনা ভাইরাসের মরণ থাবার ঝুঁকিতে তা আর হচ্ছে না। ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো … মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা /অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।’ সবার মনে পহেলা বৈশাখের সেই চিরায়ত গান গুঞ্জরিত হলেও এবারে তার আবেদন ভিন্ন। ওরে আজ তেরা যাসনে ঘরের বাহিরে । রবীন্দ্রনাথের এ শ্লোগানেই হবে এবারের বৈশাখ। রমনা বটমূল প্রাঙ্গণ আজ জনশূন্য,হচ্ছেনা মঙ্গল শোভাযাত্রা। শাহবাগ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানসহ দেশের প্রতিটি উৎসব কেন্দ্র জনমানবহীন। এমন অনাড়ম্বর পহেলা বৈশাখ আর কখনোই আসেনি বাঙ্গালী জাতির জীবনে। ছায়ানট, বর্ষবরণ শুরু হওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধের সময়কাল ছাড়া নিয়মিতভাবেই রমনার বটমূলে বর্ষ আবাহনের ডাক দিয়ে অনুষ্ঠান করে এসেছে। এবারই তা হচ্ছে না। কারণ, বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে এখন চলছে করোনা আতঙ্ক । পৃথিবীতে এখন চলছে এক অনিশ্চিত সময়। তবে এবারের নবাবর্ষ ডিজিটাল পদ্ধতিতে ঘরে বসেই পালন করার জন্য বলা হয়েছে।আজ সরকারি বেসরকারি টেলিভিশনে ও বাংলাদেশ বেতার বিশেষ অনুষ্ঠান সম্প্রচার করবে। এ উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী পৃথক পৃথকভাবে শুভেচ্ছা বাণী দিয়েছেন।নববর্ষে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম সমাজের জঞ্জাল সরাতে ঘোষণা করেছেন নতুনের মহত্তম আহবান ‘ঐ নতুনের কেতন ওড়ে…. তোরা সব জয়ধ্বনি কর’।পহেলা বৈশাখ, কেবল জ্যোতির্বিদ্যা নিরূপিত পৃথিবী আহ্নিক গতির ওপর নির্ভরশীল একটি দিন তা নয় বরং এটা আমাদের জীবনে চেতনা এবং স্বকীয় সংস্কৃতির পরিচয়ও বটে। যদিও অপসংস্কৃতির চর্চার বাড়াবাড়িতে এই দিনটি প্রায় ফসিল হয়ে এসেছে।
বাংলা নববর্ষ বাঙালি মুসলমানদের মনে প্রাণে নতুন উদ্দীপনার সৃষ্টি করে। কারণ বাংলা সাল হিজরী সালেরই ঔরশজাত। ইতিহাস বলছে, বাংলাদেশ ভূ-খন্ডে মুসলিম শাসন কায়েম হয়েছে ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজীর বঙ্গ বিজয়কাল থেকে। সে সময় এদেশে ইসলামী সভ্যতার সাবেক হিজরী সালের প্রতিষ্ঠা হয়। পরবর্তীতে খাজনা আদায়সহ রাজকার্যের সুবিধার জন্য মোঘল সম্রাট আকবর হিজরী পাশাপাশি বাংলা সাল প্রবর্তন করেন এবং অগ্রহায়নের পরিবর্তে বৈশাখ থেকে বর্ষ গণনা শুরু করেন। বাংলা মাস পায় রাজকীয় মর্যাদা। এর আগে এই ভূ-খন্ডে মহা ধুমধামের সাথে ‘নওরোজ’ উৎসব পালিত হতো। বাংলা সালের গণনা শুরু হয় ১৫৫৬ ঈসাব্দের ১১ এপ্রিল থেকে। তবে আমাদের দেশে সরকারিভাবে বাংলা সাল-তারিখ ব্যবহার হয় না বললেই চলে।
বাংলা নববর্ষ উদযাপনের সবচেয়ে বড় দিকটি হলো বৈশাখী মেলা। সারাদেশে অসংখ্য বৈশাখী মেলা হয়ে থাকে । পহেলা বৈশাখে ঢাকা পরিণত হয় মেলার নগরীতে। বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণে লোকজ মেলাসহ আয়োজন করা হয় বিশেষ অনুষ্ঠানের। সাম্প্রতিক সময়ে বৈশাখের ভিন্ন আমেজের ছোঁয়া লেগেছে ব্যবসায়িক ও সাংগঠনিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে। ক্রেতা আকর্ষণে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসমূহ বৈশাখী অফার ঘোষণা করে। অডিও-ভিডিও কোম্পানিগুলোও নববর্ষ
উপলক্ষে বাজারে ছাড়ে নতুন অ্যালবাম । পত্রিকাগুলো বের করে বিশেষ সংখ্যা। হোটেল রেস্তোরাঁয় আয়োজন করা হয় পান্তা-ইলিশসহ বৈশাখী খানাপিনার রকমারি পরিবেশনা। শুভেচ্ছা বিনিময়ে কাগুজে কার্ডের পাশাপাশি ব্যবহৃত হয় ই-মেইল, এসএমএস। বৈশাখী সাজ-পোশাকে ছেলে-বুড়ো সকলে সজ্জিত হয়ে অনন্য সাধারণ আনুষ্ঠানিকতায় নববর্ষকে বরণ করে নেয় এক ভিন্ন সাধের অভিন্ন আমেজে। করোনার কারণে সবকিছু আজ ম্লান হয়ে গেছে।

SHARE